মোঃ বেলাল হোসাইন :–
দীর্ঘ প্রায় ১ মাস ১০ দিন ধরে চলা ধারাবাহিক বৃষ্টিপাতের ফলে তলিয়ে গেছে চৌদ্দগ্রামের ১০টি ইউনিয়নের প্রায় শতাধিক গ্রাম। থমকে গেছে অধিকাংশ গ্রামের জীবনযাত্রা। অনেক স্থানে চলাচলের মুল সড়ক পানিতে ডুবে যাওয়ায় শত শত লোকজন পানি বন্ধী হয়ে পড়েছে। যাদের সামর্থ আছে তারা ব্যাপক ভাড়ায় নৌকার মাধ্যমে কোনভাবে চলাচল করছে। বন্যা দুর্গত ইউনিয়নগুলো হলো উপজেলার কাশিনগর, উজিরপুর, শুভপুর, শ্রীপুর, মুন্সিরহাট, বাতিসা, কনকাপৈত, জগন্নাথদিঘী, আলকরা ও গুনবতী। এসব ইউনিয়নের মধ্যে কাশিনগর, গুনবতী এবং মুন্সিরহাট ইউনিয়নের অবস্থা বেশ বেগতিক। আশ্রয় কেন্দ্র না থাকায় এসব ইউনিয়নের প্লাবিত গ্রামের মানুষ স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন উচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। গৃহপালিত পশু সহ অনেকেই উচু স্থানে অস্থায়ীভাবে তেরপাল ও টিন দিয়ে ঘর বানিয়ে বসবাস করেছে। বন্যার ফলে নিরাপদ পানি পান করা হুমকির সম্মুখিন। বাধ্য হয়ে সবাই পানির উপরে দন্ডায়মান নলকুপের পানি পান করতে বাধ্য হচ্ছে। এতে করে অনেকের মাঝেই পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, ধারাবাহিক এই বৃষ্টিপাতের ফলে সৃষ্ট বন্যার কারনে উপজেলার ১২৩০ হেক্টর ফসলী জমির বীজতলা মধ্যে ৩৭০ হেক্টর বীজতলা তলিয়ে গেছে। এর ফলে উপজেলার রোপন বীজতলার লক্ষমাত্রা ১৮ হাজার ৩০০ হেক্টরের মধ্যে প্রায় ৩,৫০০ হেক্টও ফসলী জমিন রোপন করা সম্ভব হবে না। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সরওয়ার জাহাঙ্গীর জানান, গত ২০০৪ সালের পর এই পর্যন্ত সময়ে সবচেয়ে ভয়াবহ বৃষ্টিপাতের ফলে সৃষ্ট এই বন্যায় উপজেলায় এই পর্যন্ত ৪৬৮ টি পুকুরের ৪৭.৩ হেক্টর পমিান অংশের পুকুর ও মাছের ঘের প্লাবিত হয়েছে। এসব পুকুরে এবং জলাশয়ে চাষ করা পোনা এবং বড় মাছের ক্ষতির পরিমান প্রায় ৪ কোটি ৫ লক্ষ টাকা। এসব ক্ষয়ক্ষতিতে হাজার হাজার কৃষক সহায় সম্ভল হারিয়ে মৃতপ্রায়। ক্ষতিগ্রস্থ এসব মাছচাষীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো উপজেলার বাতিসা ইউনিয়নের মাশকরা গ্রামের আব্দুল হালিম, উপজেলার কনকাপৈত ইউনিয়নের জঙ্গলপুর গ্রামের নজরুল ইসলাম, মুন্সিরহাট ইউনিয়নের বাংপাই গ্রামের সাইফুল ইসলাম, শুভপুর ইউনিয়নের উনকোট গ্রামের শামিম মজুমদার, জগন্নাথদিঘী ইউনিয়নের বিজয়করা গ্রামের সফল মাছ চাষী মোঃ রিয়াদ, কনকাপৈত ইউনিয়নের হিংগুলা গ্রামের ফারুক মজুমদার প্রমুখ। উপজেলার বুকের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া কাঁকড়ি ও ডাকাতিয়া নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। চলমান এই বৃষ্টিপাত আর ২-১ দিন অব্যাহত থাকলে একেবারেই তলিয়ে যাবে উপজেলার অধিকাংশ ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্থ এসব গ্রাম।
এদিকে চলমান টানা বর্ষনের ফলে সৃষ্ট বন্যার কারনে উপজেলার প্রায় ৮-১০ টি স্কুলের পাঠদান সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষনা করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ অনেক স্থানে সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা যায় উপজেলার মুন্সিরহাট ইউনিয়নের খিরনশাল গ্রামের কাজী জাফর আহম্মেদ উচ্চ বিদ্যালয়ের চতুর্দিকে কোমর সমান পানি। সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষনা করা হয়েছে এই স্কুলের পাঠদান। স্কুলের পাশে প্রায় সকল বাড়ীর লোকজন পানি বন্ধী। একটি বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় পরিবারের সবাই পানির উপরে ভাসমান খাটের উপর বসে আছে। তাদের ব্যবহারিত নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল জিনিষপত্র পানিতে ভাসছে। খাওয়ার পানির টিউবওয়েলটিও প্রায় পানির নিচে কোনভাবে মাথা উঠিয়ে দন্ডায়মান। এই ভাসমান টিউবওয়েলের পানি পান করে পরিবারের গৃহিনীর শরীরে পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। মহিলার পায়ের বেশ কিছু অংশে ধরেছে পচন রোগ।
সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা যায় চলমান টানা বর্ষনের ফলে সৃষ্ট বন্যা মূলত বর্ষন এবং ভারত থেকে আসা পানির কারনের পাশাপাশি ডাকাতিয়া নদিতে সরাসরি বাঁধ এবং জালসহ বাঁশের তৈরি বাঁধের সাহায্যে মাছ ধরার জন্য প্রতিবন্ধকতাও সমানভাবে দায়ী। দেখা যায় শুধুমাত্র মুন্সিরহাট ইউনিয়নের মধ্যে অবস্থিত ডাকাতিয়া নদীর অংশে অনেক স্থানে এভাবে বাঁধ দিয়ে রাখা হয়েছে। বাঁধ দেওয়া এসব এলাকাগুলো হলো খিরনশাল, সিংরাইশ, মিতল্লা এবং ছাতিয়ানী। এসব বাঁধের সাথে স্থানীয় প্রভাবশালীরা জড়িত থাকার কারনে ভুক্তভোগী সাধারন মানুষ কিছুই করতে পারে না। টাক্ষতিগ্রস্থ এলাকার লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, টানা বৃষ্টি ছাড়াও উপজেলার অধিকাংশ নদীর মধ্যে মাছ ধরার জন্য বসানো বাঁশের বাঁধের কারনে পানি সহজে সরছে না। এর কারনে পানি আটকে থেকে প্লাবিত হচ্ছে এসব এলাকা। ক্ষতিগ্রস্থ ঐ মহিলা জানান, তার পরিবারের রান্নাবান্না বন্ধ কিন্তু এখনো কোন ধরনের ত্রান পাননি উনি। এছাড়া খিরনশাল কাজী জাফর আহম্মেদ উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক আব্দুল কুদ্দুস পাটোয়ারী জানান, গ্রামের প্রায় ৩৫টি পরিবার পানি বন্ধি। এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান মাহফুজ আলম সোমবার সকালে গ্রামের বন্যাকবলিত পরিবারের মাঝে ত্রান বিতরন করেন। তিনি খিরনশাল কাজী জাফর আহম্মেদ উচ্চ বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ রাখার ঘোষনা করেন। আমরা সেমতে স্কুলের পাঠদান সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছি। পানি সরে গেলে আমরা আবার স্কুলের পাঠদান চালু করব।
চৌদ্দগ্রাম উপজেলা নির্বাহী অফিসার দেবময় দেওয়ান জানান, উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের ৫০ টির অধিক গ্রাম বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ। চলমানা টানা বর্ষনের পাশাপাশি পাশ্ববর্তী ভারত থেকে আসা পানিই এই বন্যার মূল কারন। ইতিমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্থ বিভিন্ন এলাকায় ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের মাঝে শুকনো খাবার, আমসহ বিভিন্ন ত্রানসামগ্রী বিতরন করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে ক্ষতিগ্রস্থ গ্রামগুলোর লোকদের পাশে থাকার জন্য। তিনি আরও জানান, উপজেলার ৭টি স্কুলের পাঠদান সাময়িকভাবে ইতিমধ্যেই বন্ধ ঘোষনা করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ অনেকের নদীতে বাঁধের বিষয়ে অভিযোগ করলে তিনি জানান, আপনারা সাহসি হয়ে নিজেরা ভূমিকা রেখে বাঁধগুলো ভেঙ্গে দেন। কেউ যদি বাঁধা দেয় আমাকে ফোন করলে আমি তাকে পুলিশে ধরিয়ে দেব। এছাড়াও বন্যা দুর্গতদের মাঝে যাতে করে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব না ঘটে সে বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহনের কথাও তিনি জানান।
