—-সিকদার আবুল বাশার
প্রচুর সংখ্যক নিুমানের সাহিত্যের ভীড়ে আমাদের মূল ধারার সাহিত্য ও গবেষণা হারিয়ে যেতে বসেছে। মহান একুশের বইমেলায় বর্তমানে যে-সকল বই প্রকাশিত হচ্ছে তা কি সব সাহিত্য মানে উত্তীর্ণ? প্রতিবছর হাতে গোনা কিছু মানসম্পন্ন সাহিত্য ছাড়া অধিকাংশ সাহিত্যই যে শিল্পমানে, সামাজিক দায়বদ্ধতার বিচারে আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মতোÑতা কি বলার অপেক্ষা রাখে? এ সব সাহিত্য কি আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য সুখকর? বাংলাদেশের একুশের বইমেলায় যে-সকল বই ‘খই-মুড়ি’র মতো চলছে তা কি শিল্পগুণে মানসম্মত সাহিত্য? মিডিয়ায় যে-সকল প্রতিষ্ঠানের বইয়ের প্রচার বেশি বেশি করা হয়েছে তার অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান-ই আগামী দিনে প্রকাশনা শিল্পে টিকে থাকবে কিনা তা নিয়ে আমাদের গভীর সংশয় রয়েছে। আজ আমাদের মূলধারার সুসাহিত্যিক, মেধাবী গবেষক উপযুক্ত মর্যাদা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে যেমন হারিয়ে যেতে বসেছে, তেমনই মানসম্পন্ন ও মূলধারার প্রকাশক বিপন্ন হতে বসেছে এই চানাচুর সাহিত্যের ভিড়ে। বাংলা একাডেমি’র মাসব্যাপী একুশের বইমেলা আয়োজনের ফলে বহু সংখ্যক অলেখক, অপপ্রকাশক ও অপ্রতিষ্ঠান ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে।
বাঙালির ভাষা-সংস্কৃতি সম্পর্কিত গবেষণা, মননশীল ও সৃষ্টিশীল গ্রন্থ প্রকাশের প্রাণ কেন্দ্র বাংলা একাডেমি। গবেষণাকর্মের কাজ প্রায় বাদ দেওয়ার ক্রান্তিলগ্নে পৌঁছে গিয়ে বইমেলার নামে বাজারি সাহিত্যের আখড়ায় পরিণত হতে বসেছে বাংলা একাডেমি। এটি দুঃখজনক হলেও সত্য যে, যাঁরা জাতির মননের প্রতীক বলে পরিচিত, যাঁরা এ দেশের সিভিল সোসাইটি বলে পরিচিত তাঁরা কখনও বাংলা একাডেমি তথা মহান একুশের এই বইমেলার ক্রমাবনতি রোধ করতে সোচ্চার হয়েছেন এমন খবর আমাদের জানা নেই। এ থেকে আমাদের বর্তমান ও আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করার জন্য বুদ্ধিজীবী ও বিবেকবান মানুষদের এগিয়ে আসতে হবে। এই ধরনের মাসব্যাপী বইমেলায় লাভবান হচ্ছে যেমন একশ্রেণির ভূইফোঁড় লেখক ও প্রকাশক, তেমনি আগামী প্রজন্ম যে ক্যান্সার রোগাক্রান্ত রুগীর মতো প্রকৃত জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্যের রস আস্বাদন থেকে বঞ্চিত হয়ে অদৃশ্য মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছেÑ এ বিষয় থেকে উত্তোরণের উপায় নিয়ে কেউ ভাবছে না। এটি জাতির জন্যে গভীর উদ্বেগের বিষয়। গবেষণামূলক কাজ করার জন্য বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। সেই কাজটি থেকে বাংলা একাডেমি দূরে সরে গিয়ে বইমেলার মতো একটি অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজ নিয়ে তাদের সারা বছর ব্যস্ত থাকা উচিত নয়। বাংলা একাডেমি বিশাল অঙ্কের সরকারি অর্থ ব্যয় করে প্রতিবছর যতগুলো বই প্রকাশ করে তারচেয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সরকারি সহযোগিতা ছাড়া অনেক বেশি বই প্রকাশ করছে। বাংলা একাডেমি স্টল বরাদ্দের শর্ত হিসেবে প্রত্যেক প্রকাশককে ২৫টি বই প্রকাশ বাধ্যতামূলক করেছে। ফলে কিছু সংখ্যক বড় প্রকাশক ব্যতীত অন্যরা নিুমানের, সারবত্তাহীন গ্রন্থ প্রকাশে একরকম বাধ্য হয়ে পড়ে। এগুলো থেকে আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করতে আমাদের নৈতিক দায়বদ্ধতা থাকা দরকার।
এই ধরনের বাজারি বইমেলা থেকে জাতি কতটা উপকৃত হবে সেটা আমাদের গভীর ভাবনার বিষয়। আমরা চাই এদেশে কিছু সৎ সাহিত্যিক ও সৎ প্রকাশক বেঁচে থাকুক। বাংলা একাডেমি যে কাজের জন্য তৈরি করা হয়েছিল সেই কাজই গুরুত্বের সাথে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এই আমাদের প্রত্যাশা। সরকার অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে এই বইমেলা পরিচালনা করার দায়িত্ব অর্পণ করে বাংলা একাডেমির মতো গুরুত্বপূর্ন প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করবে বলে আমি আশাবাদী। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এ রকমের মাসব্যাপী কোনো বইমেলা হয় কিনা তা আমার জানা নেই। মাসব্যাপী বইমেলা করে লাভের চেয়ে ক্ষতি হচ্ছে বেশি। এই বইমেলা তৈরি করছে এক শ্রেণির ভূইফোঁড় লেখক ও প্রকাশক। এরা সাহিত্যের নামে অসাহিত্য তৈরি করছে। বর্তমান প্রজন্ম বাঙালি জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্য ভুলতে বসেছে। এদের রক্ষা করা আমাদের সকলের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
আসুন, আমরা সবাই এই মাসব্যাপী বইমেলা বন্ধ করে ৭-১০ দিনের বইমেলার আয়োজন করি। তাহলে কিছুটা হলেও ভূইফোঁড় লেখক ও প্রকাশকদের রমরমা ব্যবসা বন্ধ হবে। আর জাতি রক্ষা পাবে এই অপসংস্কৃতি থেকে। আপনারা একটু ভাবুন, বাংলা একাডেমিতে যে-সকল লেখকদের বই পাঠকরা ‘খই-মুড়ির’ মতো কিনে নিচ্ছে সেই পাঠকেরা কি চেনেন আমাদের কালজয়ী লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়, মানিক বন্দোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলীর মতো অনেক সুসাহিত্যকদের? আমরা মনে করি, যোগ্য কবি, সাহিত্যিক ও গবেষকগণকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করে আগামীতে ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’ প্রদান করা উচিত। যেমন, প্রবন্ধকার-সাহিত্যিক আহমেদ ছফা, কবি আবিদ আজাদ ও খন্দকার আশরাফ হোসেন-কে বাংলা একাডেমি পুরস্কার না পেয়েই মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে, এবং এখনো অনেক যোগ্যতর লেখকদের পুরস্কৃত না করে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতার লেখকদের দলীয় বিবেচনায় পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এটি কাম্য নয়। আমরা যারা নিঃস্বার্থভাবে বাঙালি জাতির ইতিহাস ঐতিহ্যসহ ৬৪ জেলার ইতিহাস ও ৬৪ জেলার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ করে আসছি তাদেরকে মিডিয়া তেমন প্রচার করে নি।
নিুেউল্লিখিত গ্রন্থগুলো বাঙালি জাতির ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আমি মনে করি। হাজার বছর বেঁচে থাকবে এই বইগুলো। অথচ প্রচার মাধ্যমের দৃষ্টিতে গ্রন্থগুলো কেন প্রত্যাশিতভাবে প্রচারিত হয় নি তা চিন্তার উদ্রেক করে বৈকি। আমাদের উচিত যে-কাজ বাঙালি জাতির উপকারে আসবে সে কাজটি গ্রহণ করা। আর যে কাজটি উপকারে আসবে না তা পরিহার করা।
=================================
* সিকদার আবুল বাশার, গবেষক ও প্রকাশক
গতিধারা ৩৮/২ক বাংলাবাজার ঢাকা ১১০০
ফোন : ৭১১৭৫১৫, ০১৭১১৬০২৪৪২
e-mail : gatidhara@gmail.com, gatidhara@yahoo.com