মো. কামাল উদ্দিন: কুমিল্লা :–
বর্নাঢ্য আয়োজন আর উৎসবমুখর পরিবেশে অবশেষে শুক্রবার সম্পন্ন হলো রেলপথ মন্ত্রী মো. মুজিবুল হক মুজিবের বহুল আলোচিত বিয়ে। একইসঙ্গে দেশের ইতিহাসে প্রথম মন্ত্রী হিসেবে কারও কুমারজীবনের ইতি ঘটলো। বিকালে ৫ লাখ ১টাকা দেনমোহরের ভিত্তিতে বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর আনুষ্ঠানিকতা শেষে সন্ধ্যা ৬টার দিকে গ্রামের মেঠোপথ পেড়িয়ে নববধূ হনুফা আক্তার রিক্তাকে নিয়ে রেলপথমন্ত্রী সড়কপথে ঢাকার বেইলী রোডের মিনিস্টার্স এ্যাপার্টমেন্টের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন।
জানা যায়, গতকাল শুক্রবার বেলা ২টা ৫৫ মিনিটে জাতীয় পতাকা সুশোভিত পাজেরো গাড়ীতে চড়ে মন্ত্রীবর মুজিবুল হক ফুল দিয়ে অপরুপে সাজানো গাড়ীতে করে পৌঁছান কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার ১০নং গল্লাই ইউনিয়নের মিরাখলা গ্রামে। তাকেসহ বরযাত্রীদের ফুলের পাপড়ী ছিটিয়ে বরণ করে কনেপক্ষ। তার পড়নে ছিল গাঢ় সোনালী রঙের শেরওয়ানি ও কিছুুটা সাদা রঙের উপর সোনালী কাজের টুপি, হাতে রুমাল। এসময় তার গাড়ীতে ছিলেন সাবেক আইনমন্ত্রী অ্যাড. আবদুল মতিন খসরু এমপি, যুবলীগ নেতা শাহিনুল হক শাহীনসহ তার নিকটাত্মীয়রা। কিন্তু বর মন্ত্রী হলেও সরাসরি ঢুকতে পারেননি বিয়ের অনুষ্ঠানস্থ বরের আসনে। পথে বাঁধ সাধে ১২-১৩ বছরের ৬ শিশু খাদিজা, আলো, ময়না, দীনা, শাওন ও হেলাল। দৃষ্টিনন্দন প্রধান ফটকে মন্ত্রীবরকে আগলে দাঁড়ায় তারা। তাদের ৫ হাজার ১টাকা নজরানা দিয়ে শিশুদের থেকে ছাড়া পেলেন মন্ত্রীবর মুজিবুল হক। পরে একটু এগিয়ে গাড়ী থেকে নেমে তিনি হেঁটে গিয়ে বসলেন বরের আসনে। ৩টি প্যান্ডেল করা হয়েছে মেহমানদের আপ্যায়নের জন্য। বাড়ীর পূর্বাংশে অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাতে একটি, পশ্চিমাংশে অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য একটি এবং দুই প্যান্ডেলের মাঝে আরো একটি প্যান্ডেলে বর ও ভিআইপিদের জন্য একটি প্যান্ডেল করা হয়েছে। অতিথিদেরকে কাচ্চি বিরিয়ানী, চিকেন রোস্ট, জালি কাবাব, আলু বোখারা, চাটনী, বোরহানী, মিনারেল ওয়াটার ও কোল্ড ড্রিংকস দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। বরকে দেয়া হয় আস্ত খাসির রোস্ট। বিকাল ৪টা ৩০ মিনিটে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে পড়ান স্থানীয় মসজিদের ইমাম ক্বারী আবদুল লতিফ। নিকাহ্ রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন করেন গল্লাই ইউনিয়নের কাজী মাওলানা ছিদ্দিকুর রহমান। ৫ লাখ ১টাকা মূল্যের কাবিনে বর ও কনে স্বাক্ষর করেন। এ বিয়েতে উকিল করা হয় মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ডিএমডি আবুল হাসেম। বিয়ের কাবিনে বরপক্ষে স্বাক্ষী রাখা হয় মন্ত্রীর পিএস গোলাম কিবরিয়া, চৌদ্দগ্রামের ৪নং শ্রীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহজালাল মজুমদার, চৌদ্দগ্রাম পৌরসভার মেয়র মিজানুর রহমান এবং কনেপক্ষে গল্লাই ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ফজলুল করিম। এসময় কনের পড়নে ছিল সোনালী রঙের শাড়ির উপর পুঁতির কাজ করা লেহেঙ্গা। অনুষ্ঠানে অতিথিদেও মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মহিলা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকী, জাতীয় সংসদ সদস্য অধ্যাপক আলী আশ্রাফ, তাজুল ইসলাম, সাবেক এমপি নাসিমুল আলম চৌধুরী নজরুল, জেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম আহবায়ক অধ্যক্ষ আফজল খান এডভোকেট, জেলা পরিষদ প্রশাসক আলহাজ্ব ওমর ফারুক, পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি সফিকুর রহমান, রেলওয়ের মহাপরিচালক মো.তফাজ্জল হোসেন, এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী ওয়াহিদুর রহমান, কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মো: হাসানুজ্জামান কল্লোল, পুলিশ সুপার টুটুল চক্রবর্তী. পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেনী পেশার লোকজন অংশ নেয়।
কনের (হনুফা আক্তার রিক্তা) বাড়ি মিরাখোলার সবুজ ঘেরা ছোট একটি গ্রামে। যে গ্রামে লোক সংখ্যা প্রায় ১৭’শর মতো। কিন্তু বিয়ের দিন শুধু কনের বাড়িটি ঘিরেই লোকসংখ্যা পরিমাণ ছিল প্রায় সাড়ে ৪ হাজার। চান্দিনার কুটম্বপুর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিয়ে কনের বাড়িতে আসার সময় রাস্তার দু’পাশে ছিল সব বয়েসী মানুষের উপচে পড়া ভিড়। একটি বারের জন্য বরের হাত ছুঁতে রাস্তা ধরে দাঁড়িয়ে ছিল শত শত লোক। যাদের অধিকাংশই ব্যস্ত ছিলেন মোবাইল ফোনে ছবি ও ভিডিও করতে। কেউ বা বর ও যাত্রীদের গাড়িতে ছিটিয়ে দেন ফুলের পাপড়ি। কৃষি আর সবজি জমিতে চাষরত শ্রমিকরাও রাস্তার পাশে দাঁড়ান বরকে দেখার জন।
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মধ্য বয়েসী নারী বিলকিস বেগমের হাতে ছিল একটি শাড়ি ও সাবান ভরা কেছ। জানালেন তিনি গোসল করতে এসেছিলেন, বরকে দেখার জন্য প্রায় দেড়ঘন্টা যাবত গোসল না করেই রাস্তার পাশে ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ২ মাসের শিশু কন্যা সায়মা’কে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন আসমা আক্তার, পাশেই ৭০ বছর বয়সী শাশুড়ি লায়লা বানু। আসমার ভাষ্য, মন্ত্রী বর (রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হক) বিয়ের প্রচার কয়েক মাস ধরেই সমানতালে হচ্ছে। বর বেশে মন্ত্রীকে একটি বার দেখার জন্য কোলের শিশুকে নিয়েই পথে দাঁড়িয়ে রইলাম। এদিকে বরকে স্বাগত জানাতে কুটুম্বপুর থেকে কনের বাড়ি পযর্ন্ত প্রায় ১১ টি তোরণ তৈরি করা হয়। যার মধে ৯টি তোড়ণই স্থানীয় গ্রামবাসীদের উদ্যোগে করা হয়। তোরণ নির্মাণকারীরা জানান, এ বিয়ে ইতিহাস হয়ে থাকবে, যে ইতিহাসে স্বাক্ষী হয়ে থাকতেই গ্রামবাসীর সঙ্গে তারা ৫/৬ জন বন্ধ্ ুমিলে একটি তোরণ তৈরী করেছেন। এদিকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাস্তার মোড়ে মোড়ে ছিল পুলিশ, আনসারসহ প্রায় ২’শ স্বেচ্ছাসেবক। যারা নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন। একই সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের প্রায় সহ¯্রাধিক নেতাকর্মী বিয়ে অনুষ্ঠানে যোগ দেন। অপর দিকে প্রায় ১’শ ৫৬ টি বিলাসবহুল গাড়ির বহর নিয়ে ঢাকা থেকে বর আসেন কনের বাড়িতে। বর ও যাত্রী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের সর্বস্তরের কর্মকর্তারা ছিলেন। কনের ভাই আলাউদ্দিন জানান, ৫ ভাই ২ বোনের মধ্যে রিক্তা (কনে) সবার ছোট। সবার আদরের। এদিকে কনের বাবা না থাকায় (মৃত্যু) মা জোসনা বেগমই কনেকে বরের হাতে তোলে দেন। তখন সন্ধ্যা ৬টা। এ সময় কনে কান্নায় ভেঙে পড়েন। কাঁদেন স্বজনরাও। এর আগে রাজধানীর মিনিষ্টার্স অ্যাপার্টসেন্ট থেকে বর যাত্রা শুরু হয় বেলা ১১টায়। দুপুর সোয়া ১টায় দাউদকান্দির শহীদ নগর বাজার জামে মসজিদে নামাজ আদায় করেন বরসহ বর যাত্রীরা।