মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমী’র সুফিবাদ ও কবিত্ব

—মো.আলী আশরাফ খান

১২০৭ সালে এই খ্যাতিমান সুফি কবি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমী ঐতিহাসিক স্থান বলখে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম শেখ বাহাউদ্দিন বলখী। যিনি একজন খ্যাতিমান ইসলামি চিন্তাবিদ হিসেবে সমগ্র বিশ্বে তাঁর আলোর প্রদীপ প্রজ্জ¦লিত করেছিলেন। এই বিখ্যাত সুফি সাধক তাঁর সন্তান জালাল উদ্দিনকে প্রকৃত মানুষ রূপে গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রা.) এর বংশধর ছিলেন জালাল উদ্দিন রুমী।
জালাল উদ্দিন রুমীর শিক্ষা জীবনে প্রথম বাবার কাছে এবং পরে তার বাবার অনুসারীদের মধ্যে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ সাইয়েদ বোরহানুদ্দিন মোহাক্কিক এর নিকট শিক্ষা লাভ করেন। তিনি জালাল উদ্দিনকে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি জাগতিক বিষয়েও বিস্তরিত উচ্চতর শিক্ষা লাভের চেষ্টা করেন। সুফিত্ব অর্জনে জালাল উদ্দিন রুমী উজ্জীবিত হয়েছিলেন সাইয়েদ বোরহানুদ্দিনর কাছে থেকে। এছাড়াও অপরাপর ইসলামি চিন্তাবিদের কাছ থেকে তিনি শিক্ষা গ্রহণ করে নিজের জ্ঞানভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। জালাল উদ্দিন রুমী সুফিবাদকে প্রায়োগিক দৃষ্টি কোণ থেকে দেখেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বৈরাগ্যের জীবন আল্লাহর কাম্য হতে পারে না। আল্লাহ মানুষকে হাত ও পা দিয়েছেন এগুলো ব্যবহার করার জন্য। ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে এই যে, একজন মানুষ যথাসাধ্য চেষ্টা করবে এবং ফলাফলের দায়িত্ব ছেড়ে দেবে আল্লাহর ওপর।’
এভাবে তিনি সূফিদের মধ্যে জীবন সর্ম্পকে প্রায়োগিক ও বাস্তববাদী দৃষ্টিভক্তি তুলে ধরেছেন। জালাল উদ্দিন রুমী ইসলামের একজন মহান ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ইসলামি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত বিজ্ঞ ও শিষ্যদের দ্বারা তিনি সব সময় পরিবেষ্টিত থাকতেন। মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমীর সঙ্গে শামস-ই তাবারিজের সাক্ষাত ঘটে। হিজরী ৬৪২ সনের এই স্বাক্ষাতটি এক অদ্ভত পরিবর্তন সাধন করেছিল জালাল উদ্দিন রুমীর জীবনে। জাগতিক সকল চাওয়া পাওয়া থেকে তিনি বিরত হয়ে আধ্যাত্মিক শিক্ষক শামস-ই তাবারিজের সেবায় নিজেকে পুরোপুরি সর্ম্পণ করেন। তার এই আকস্মিক পরিবর্তনে শিষ্য সকল অস্থির হয়ে ওঠেন। কোনোভাবেই শান্ত করতে পারছিলেন না তাদেরকে শামস-ই-তাবারিজ। কোনো একরাতে তিনি কাউকে কিছু না বলে কেনিয়া চলে যান। শিক্ষকের সঙ্গে এই বিচ্ছেদ মাওলানা রুমীকে দারুণভাবে ব্যথিত করে। এতে তাঁর পারিবারিক শান্তিও কিছুটা বিঘিœত হয়। ফলে তাঁর বড় ছেলেকে দায়িত্ব দেওয়া হয় শামস-ই-তাবারিজকে খুঁজে বের করার। তিনিই তাকে দামেস্ক থেকে কেনিয়ায় ফিরিয়ে আনেন। কিন্তু আবারও তাকে চলে যেতে হয় আগের বারের মতই জালাল উদ্দিন রুমীর ভক্ত শিষ্যদের বেপরোয়ার কারণে। পরে আর তিনি কখনই ফিরে আসেননি। এই আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষক শামস-ই তাবারিজ নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার ঘটনাটি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমীকে বেদনাতুর করে। তিনি তার বেদনা আবেগকে নিবৃত্ত করতে শুরু করেন কাব্যচর্চা। আর এ সময়েই তিনি রচনা করে ফেলেন অমর দীর্ঘ কবিতা-‘মসনবী’। মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমীর দু’টি সংকলন বিশ্বব্যাপি খ্যাতি অর্জন করেছে। এর একটি এই ‘মসনবী’ অপরটি ‘দিওয়ান’। তার রচনার ‘দিওয়ান’ শীর্ষক কবিতায় রয়েছে ৫০ হাজার লাইন। এসবের অধিকাংশই সুফি ভাবধারায় রচিত। জালাল উদ্দিন রুমীর অতিপ্রিয় আধ্যাত্মিক গুরু শামস-ই-তাবারিজকে হারানোর পর থেকেই এসব দীর্ঘ কবিতা রচনা করেছেন। তার মানবীর ৬ খন্ডে ২৬ হাজার ৬’শ ৬০ লাইন কবিতা দ্বারা সমৃদ্ধ। তিনি দশ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিরলস প্রচেষ্টায় ইতিহাসের এই বিরল কার্য সম্পাদন করেছিলেন।
তার কবিতা সমূহে রয়েছে ধর্মের আলোকরশ্মি, প্রকৃতি এবং চিরন্তন জ্ঞানের রহস্যে ভরা সত্যের অন্বেষা। তার ‘মসনবী’কে সুফি কাব্যের চুড়ান্ত বিকাশ বলে বিশিষ্ট গবেষকগণ মনে করেন। ফারসী ভাষায় রচিত ‘মসনবী’ বুদ্ধিজীবি ও ধর্মপরায়ণ ব্যক্তিদের কাছে একটি প্রিয় গ্রন্থ হিসেবে আজো টিকে আছে। তাঁর এ সকল কবিতা গ্রন্থ অত্যাধিক জনপ্রিয়তার মূলে সুস্থ ও সুন্দর চিন্তার পরিশুদ্ধতাই। জালাল উদ্দিন রুমীর কাব্য অনুরাগ বা পরিস্ফুটন এমন এক মুহুর্তে ঘটেছিল যখন পারস্য তথা সমগ্র বিশ্বের জন্য তা প্রয়োজন ছিল। তাঁর এই সমস্ত গীতিকবিতা ওইসময় নানাভাবে প্রশংসা কুড়িয়ে ছিল; উপকৃত করেছিল জ্ঞান পিপাসুদের। তার এই কাব্যচর্চা যেমন ক্রমবর্ধমান সামাজিক ক্ষত থেকে নিজেকে রক্ষা করেছিল তেমনি সমাজের অন্যান্য মানুূষকেও বাঁচিয়ে ছিল কষ্টদায়ক ক্ষত থেকে। আমাদের জানা মতে, মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমী তাঁর কবিতায় যে সত্যিকারের আবেগ ঢেলে দিয়েছিলেন তা মনে হয় অন্য আর কোন কবি দিতে পারেননি। পারবেন কিনা তাতেও সন্দেহ রয়েছে। তাঁর কবিতার মধ্যে ছিল আন্তরিকতার সঙ্গে গভীর প্রেমের পরশ। তিনি ব্যক্তি জীবনে উদার ও মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। যখনই মানুষ তাকে যে কোন উপঢৌকন প্রদান করতেন তিনি তা দরিদ্রদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন। অনেক সময় তাঁর ঘরে খাবার থাকতো না। তখন তিনি আনন্দচিত্তে বলতেন, ‘আজ আমাদের বাড়ি দরবেশের বাড়ির মতই’। ইসলামের এই মহান সাধক ১২৭৩ সালে তাঁর অনেক সৃষ্টিশীল কর্ম আমাদের মাঝে রেখে পরপারে চলে যান। তাকে দাফন করা হয় কেনিয়ায় তাঁর বাবার কবরের পাশে। এই খ্যাতিমান সুফি কবি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমীর কবর দর্শনের জন্য এখনও বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অগণিত মানুষ কেনিয়ায় আসে।

==============================
লেখক: কবি, কলামিস্ট ও ফ্রিল্যান্স জার্নালিস্ট
গৌরীপুর, দাউদকান্দি, কুমিল্ল¬া

Check Also

মিনি ওয়াক-ইন-সেন্টারের মাধ্যমে রবি’র গ্রাহক সেবা সম্প্রসারণ

ঢাকা :– গ্রাহক সেবাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে মোবাইলফোন অপারেটর রবি আজিয়াটা লিমিটেড সম্প্রতি মিনি ওয়াক ...

Leave a Reply