—মো.আলী আশরাফ খান
অপ্রিয় হলেও সত্য যে, আজ আমাদের সমাজে পরকীয়া নামের সামাজিক ভয়াবহ মহাব্যাধিটি পারমাণবিক বোমার তেজক্রিয়তার ন্যায় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। এই ব্যাধিটির ছোবলে এখন ধ্বংস হচ্ছে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও গোটা দেশ। যতই সময় অতিবাহিত হচ্ছে ততই এর ভয়ালতায় পুড়ছে দেশ তা আর কোনভাবেই অস্বীকার করার সুযোগ নেই। যদিও আমরা অনেক দিন ধরেই এর ভয়াবহতা সম্পর্কে জাতীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির পাশাপাশি লিফলেট বিলি ও মোটিভেশনাল সভা-সেমিনারের মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করে আসছি। কিন্তু এসব সাংগঠনিক কর্মকা- উল্লে¬খযোগ্য কোনো ফলাফল বয়ে আনেনি সরকারের যথাযথ দৃষ্টি ও মিডিয়ার সামাজিক দায়-দায়িত্ব অবহেলার কারণে। এখন যে কেউ স্বীকার করতে বাধ্য যে, পূর্বেকার তুলনায় পরকীয়া-এ সামাজিক ব্যাধিটি আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। দেশের সর্বত্র নৈতিকতার এক মহাসর্বনাশ ঘটিয়ে এই পরকীয়া সামাজিক ব্যাধিটি পারমাণবিক বোমার বিষাক্ত ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছে ব্যক্তি-পরিবার ও সমাজ তথা জাতীয় জীবনে।
অতি দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে, বর্তমানে সামাজের সিংহভাগ পুরষ ও নারী মনে করে, তাদের স্ত্রী ও স্বামীদের চেয়ে অন্য নারী এবং পুরুষরা সুন্দর ও আর্কষণীয়। শুধু তাই নয়, তারা অন্য নারী ও পুরুষদের বাহ্যিকতাকে প্রাধান্য দেয়, প্রকৃত সৌন্দর্যের সজ্ঞা ভুলে গিয়ে ভ্রান্তপথে পা বাড়ায়। ছলাকলা ও ভুলিয়েভালিয়ে পুরুষরা যেমন নারীদের মহাসর্বনাশ ঘটায় তেমনি নারীরাও দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে এই সর্বনাশের পথে। তারা তাদের বিবাহিত জীবন ছাড়াও অধিক সান্নিধ্য কামনা করছে। তাদের ধারণা, একাধিক সঙ্গ অর্থাৎ নিজ স্ত্রী ও স্বামীদের ব্যতিরেকে অন্য নারী-পুরুষ মরিচিকায় বেশি সুখ পাওয়া যায়! আর এর অন্বেষণে মত্ত হয়ে বেপরোয়া বিকৃত যৌননেশায় বুঁদ ও অপতৃপ্তির ঢেঁকুরগিলে আত্মপ্রশান্তির লোভে মরিয়া হয়ে ওঠে এসব অধিক নারী ও পুরুষ লোভীরা। এসব মূর্খরা মনে করে, ঘরের স্ত্রী’র চেয়ে অন্যের স্ত্রীরারা ভালো এবং অন্য পুরুষরা তাদের স্বামীদের চেয়ে বেশি যৌনতৃপ্তিদানে এবং আনন্দময় জীবনদানে সক্ষম! পরে অবশ্য একসময় তাদের ভুল ভাঙ্গে, বুঝতে পারে-নিজের স্ত্রী-ই ভালো এবং নিজের স্বামীই শ্রেষ্ঠ। আর তখন হয়তো জীবনের অনেকটা সময় পার হয়ে যায় এবং অন্য আরো কয়েকটি জীবনও ধ্বংস হয়ে যায়। তখন তাদের ষোলকলা পূর্ণ হয়ে অনুশোচনা ছাড়া আর কোনো কিছুই করার থাকে না।
আমরা যদি পরকীয়া সম্পর্কে একটু গভীরে যাই তাহলে দেখা যাবে যে, সমাজের বেশির ভাগ বিবাহিত-অবিবাহিত তরুণ-তরুণী ও মধ্যবয়সী নারী-পুরুষ তাদের অবসর বিনোদনে ভোগ করতে চায় অন্যকে। নিবৃত্ত করতে যারপরনাই অপচেষ্টা চালায় নিজেদের কু-প্রবৃত্তির লালসাকে। আর তাতে নিজ চরিত্রকে চরিতার্থ করে দ্রুত ধাবিত হয় বিভীষিকাময় অন্ধকারের দিকে। তারা কখনও চিন্তা করে না, এই নৈতিকতাহীন যৌনলালসায় একদিন পুড়ে ছাঁই হবে নিজে এবং পুরো ঘর-সংসার। এই পরকীয়ার বিষ-ছোবলে কখনও কখনও এমনও হয়, নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে আত্মহত্যার মতো জঘণ্য ঘটনার পাশাপাশি গর্ভপাত ও অনেক রকম অপকর্ম এবং নৃশংসভাবে খুন হতে হয় নিজ সন্তানসহ অন্যদেও।
আমরা যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখবো যে, ভিবিন্ন সংবাদ মাধ্যম এবং আমাদের চোখের সামনে বিয়ে বিচ্ছেদের যেসব ঘটনা ঘটে এর বেশিরভাগ পরকীয়ার মতো অনৈতিক ব্যাধির ভয়াবহতার কারণে। দুই যুগ আগেও গ্রামাঞ্চলে কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্তদের মধ্যে এক্ষেত্রে পুরুষরাই ছিল এগিয়ে। কিন্তু ইদানিং স্বামীরা প্রবাসে এবং সংসার উন্নয়ন-কাজকর্মে ব্যস্ত থাকার কারণে গ্রাম-মফস্বল, থানা-উপজেলা পর্যায়েও এর ব্যাপকতা ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। গ্রাম-মফস্বলের তরুণী ও মধ্যবয়সী মহিলাদের স্বামীরা যখন দীর্ঘদিন প্রবাসে অবস্থান করছে এবং জীবীকার সন্ধানে ব্যস্ত তখন তাদের স্ত্রীরা বহুগামি কিছু পুরুষের সঙ্গে প্রেম প্রেম খেলায় মেতে উঠছে, অবলীলায় তাদের অমূল্য শরীর-ইজ্জত তুলে দিচ্ছে পরপুরুষদের হাতে। এমনকি নিজ সংসারের মায়া ত্যাগ করে পরপুরুষের হাত ধরে কখনও নিজেদের সস্তান ফেলে আবার কখনও সন্তানকে সঙ্গে নিয়েই নরকে ঝাঁপ দিচ্ছে। এমনকি তারা নিজেদের সন্তানদেরকেও হত্যা করতে দ্বিধা করছেনা পরকীয়াকে টিকিয়ে রাখতে!
আর এভাবেই মানুষ নামের সংজ্ঞা হারিয়ে কিছু অমানুষ সর্বনাশের যা ঘটানো তাই ঘটাচ্ছে সমাজে। যদিও পুরুষের তুলনায় এক্ষেত্রে নারীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেশি। তারপরেও নারীর সংখ্যা গাণিতিক হারে বাড়ছে এই অকল্যাণ-নিকষ কালোা অন্ধকারের পথে। এমনও দেখা যায়, এসব ব্যভিচার চালাতে গিয়ে টাকাপয়সার লেনদেন ও একাধিক ব্যক্তিকে দেহদান করে সমঝোতায় আসতে হচ্ছে নারীদের। যা পরে এক সময় প্রকাশ হয়ে তাদের সাংসারিক ও সামাজিক জীবনে বড় ধরণের অশান্তি ও সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আমরা লক্ষ্য করছি, ইউরোপ-আমেরিকায় যে ‘ফ্রি সেক্স’ অপসংস্কৃতি রয়েছে এর দিকে আমাদের সমাজ ভয়ানকভাবে ঝুঁকে পড়ছে। সেখানে স্বাধীনতার নামে যৌনতার চলে হলিখেলা, নারী-পুরুষের সম্মতিক্রমে মেলামেশা হয় অবাধে, হোক বিবাহিত কিংবা অবিবাহিত। আমরা বুঝতে চেষ্টা করি না যে, এটা তাদের সংস্কৃতি-বিজাতীয় সংস্কৃতি। আমরা ওই সংস্কৃতি তথা যৌনতার বিষয়টিকে বেশি লক্ষ্য করে নিজেরা কুলষিত হচ্ছি এবং ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজজীবনে-এর নীল বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছি। এবং এর প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে আমাদের ছেলে-মেয়ারাও দিনেদিনে অসহিষ্ণু হয়ে ওঠছে। উদাসীন হয়ে পড়ছে স্বামী-স্ত্রী এবং অন্যান্যরাও অন্যান্যদের প্রতি। সংসারের প্রতি যে দায়-দায়িত্ব ও কর্তব্য থাকার কথা, তা ক্রমেই ভুলতে বসেছে স্বামী-স্ত্রী তথা সন্তানের বাবা-মায়েরা। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে ভালোবাসা ও আন্তরিকতা থাকা দরকার তা হ্রাস পাচ্ছে দ্রুত। যা একসময় বিবাহ বিচ্ছেদের মতো নির্মম-নির্দয় ব্যথিত কাজ পর্যন্ত গড়াচ্ছে। স্বামী ও স্ত্রী একে অপরের বিরুদ্ধে পরকীয়া, শারীরিক চাহিদা পুরণে অক্ষমতা, সময় দেয়া-নেয়া এমনকি দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকার বাহানায় এক পর্যায়ে পরকীয়া অতঃপর বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটাচ্ছে অহরহ।
এজন্য আমরা এক তরফাভাবে কোনো পক্ষকেই দায়ী করতে পারি না। দেশের তথাকথিত স্বনামধন্য লেখক, গায়ক, আমলাসহ উচ্চবিত্ত শ্রেণীর লোকেরা এমন কিছু অনাকাঙিক্ষত ঘটনা ঘটাচ্ছেন, যা সাধারণদের এ ঘৃণিত পথে উৎসাহিত করছে। তাদের এ সকল পরকীয়া-বিষবাষ্প হয়ে ছড়াচ্ছে সমাজে। এমনও দেখা যায়, মেয়ের বয়সী মেয়ের বান্ধবীর সঙ্গে পরকীয়ার পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছেন দেশের নামিদামি লোকেরা। নারীরাও ছেলের বয়সী তরুণদের সঙ্গে একই রকম খেলা খেলে যাচ্ছেন। আমরা স্বাতন্ত্র বলতে যা-ই বুঝি না কেনো, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতাকে কি কেউ এড়িয়ে যেতে পারবে? যে দেশে প্রায় নব্বই ভাগ মুসলমানের বসবাস ও উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরকীয়া, অবাধ যৌন মেলামেশা ও অসম বিয়েকে সামাজ মানতে পারে না; কোনোভাবেই এই অনৈতিকতাকে মেনে নেয়া যায় না। আজ আমরা মনে করি, এ বিষয়টিকে নিয়ে সমাজসচেতনদের জরুরিভিত্তিতে চিন্তা করার প্রয়োজন রয়েছে। সবচেয়ে বড়কথা, স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত বিশেষভাবে খেয়াল দিতে হবে পরকীয়া মহাব্যাধিটির দিকে।
এর কুফল সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে জোড়ালো আন্দোলন গড়ে তোলতে হবে দেশের সব জায়গায়। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমেও বিশেষ প্রতিবেদনকে প্রাধান্য দিয়ে প্রচারের ব্যবস্থা করা জরুরি বলে মনে করছি। এর চেয়েও বড়কথা, ধর্মীয় অনুশাসনকে জাগ্রত করতে হবে সকল মানুষের মাঝে। আমরা আর চাই না, পরকীয়ার মতো ভয়াবহ ব্যাধির কারণে আমাদের নিস্পাপ শিশুদের প্রাণ যাক একের পর এক, নৃশংসভাবে খুন হোক নারী-পুরুষ তথা সৃষ্টির সেরা জীব-আশরাফুল মাখলুকাত। আমরা চাই, ইসলামের অমীয় ছায়াতলে শান্তির আভায় ভরে উঠুক সকল প্রাণ।
================================
মো. আলী আশরাফ খান
ফ্রিল্যান্স জার্নালিস্ট এ্যা- হিউম্যান মোটিভেটর
গৌরীপুর, দাউদকান্দি, কুমিল্লা।