দুখী বালকের স্বপ্ন ও অধ্যবসায়ের ফল

মোঃ আলাউদ্দিন:–

জুঁই মামণি ভাত খেতে এসো। জুঁই’র মা বললেন।
–    আসছি মা। জবাব দিল জুঁই।
–    রাজ,ু তুই এখানে কী করছিস? যা এখান থেকে, গিয়ে জুঁই’র স্কুল ড্রেসটা ধুঁয়ে দে। জুঁই’র মা বললেন।
–    জি আম্মা যাইতাছি। বলল রাজু।
জুঁই ক্লাস ওয়ানে পড়ে। রাজু ওদের বাসায় কাজ করে। জন্মের ৪ বছর পর তার মা বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। তখন থেকেই রাজুর স্বপ্ন সে বড় হয়ে ডাক্তার হবে। যেন আর কাউকে তার মায়ের মত বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে না হয়। রাজু জুঁইকে বুবুজান বলে ডাকে। কিন্তু জুঁই রাজুর চেয়ে মাত্র কয়েক মাসের বড়।
জুঁই পড়াশোনা করতে ও করাতে ভালোবাসে। আজও রাজুকে সাথে নিয়ে পড়তে বসেছে জুঁই। রাজু পড়ছে- অ, আ, ই, ঈ ইত্যাদি। হঠাৎ পড়া থামিয়ে রাজু বলল- বুবুজান, পড়াশোনা না করলে কী বড় ডাক্তার হওয়া যায় না? জুঁই রাজুকে ধমক দিয়ে বলল- তোমাকে না কতবার বলেছি পড়ার সময় কোনো আজে-বাজে কথা বলবে না? আর আমাকে বুবুজান বলবে না! হয়তো আপু বলবে, না হয় জুঁই বলেই ডাকবে।
–    জি বুবুজান, বলল রাজু।
এমন সময় জুঁই’র মা এসে প্রচন্ড ধমক দিয়ে রাজুকে জুঁই’র টেবিল গৌঁছাতে বললেন।
কলিংবেল বাজলো। রাজু গিয়ে দরজা খুলে দিল। জুঁই’র আব্বু এসেছে। তিনি খুব ভালো মানুষ।
–    জুঁই মামণি, তুমি কোথায়? এ দেখ, তোমার জন্য কি এনেছি! বললেন জুঁই’র আব্বু।
জুঁই বাবার কাছে দৌঁড়ে এসে বলল- আরে! এটাতো একটা বই।
বাবা বললেন- এটা রাজুর জন্য।
জুঁই খুব খুশি হয়। কারণ রাজুকে পড়াতে তার আর কোনো কষ্ট হবে না। জুঁই প্রতিদিন রাজুকে পড়ায়। কিন্তু জুঁই’র মা বিষয়টি ভালো চোখে দেখেন না। জুঁই’র কাছে পড়ার কারণে তিনি প্রতিদিন রাজুকে বকাবকি করেন। জুঁইও কম যায় না। সে তার বাবাকে বলে রাজুকে একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেয়। যদিও এতে জুঁই’র আম্মু রাজি ছিলেন না।
এরই মাঝে কেটে গেল কয়েক বছর। জুঁই এখন ৪র্থ শ্রেণিতে এবং রাজু ৩য় শ্রেণিতে পড়ে। জুঁই’র মা রাজুকে এখন দিনরাত মারধর করে। তাই জুঁই’র আব্বু ঠিক করলেন রাজুকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিবেন। রাজু রাজি হয়নি। তারপরেও জুঁই’র আব্বু রাজুকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে স্কুলের ৪র্থ শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দিলেন। আর রাজুর বাবাকে বলে দেন যে, তিনি প্রতি মাসে রাজুর জন্য ৫০০ টাকা করে পাঠাবেন। এ টাকার বিষয়টিও জুঁই’র মা জানতেন না। গ্রামে গিয়ে মন দিয়ে লেখাপড়া শুরু করল রাজু। বর্তমানে ও বেশ ভালো ছাত্র। ওর ক্লাস রোল এখন এক (১)। এবার সে ৫ম শ্রেণি থেকে বৃত্তি পরীক্ষা দিয়েছে। ওর বিশ্বাস, সে বৃত্তি পাবে। রাজুদের বাড়ির অল্প কিছু দূরেই জুঁই’র দাদার বাড়ি এবং তারও কিছু দূরে তার নানার বাড়ি।
গ্রীষ্মের ছুটিতে জুঁইদের পরিবারের সবাই গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে।
আজ রাজুর বৃত্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হবে। তাই তাদের স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বৃত্তি প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। জুঁই’র আব্বু সে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন এবং পরিবারের সকলেই সে অনুষ্ঠানে যাবে।
অনুষ্ঠান চলছে। সভাপতি , প্রধান অতিথিসহ সকলের বক্তব্য দেয়া শেষ। এবার বৃত্তি প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের নাম ঘোষনা এবং তাদেরকে পুরস্কার প্রদান করা হবে। নাম ঘোষণা শুরু হল- চট্টগ্রাম বিভাগে সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে বৃত্তি প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রথম হয়েছে মোঃ শাহাদাত হোসেন রাজু। জুঁই’র আম্মু হাঁ করে রাজুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। রাজু জুঁই’র আব্বুর কাছ থেকে পুরস্কার গ্রহণ করল। জুঁই’র মা নিজের ভুল বুঝতে পেরে রাজুকে শহরে নিয়ে পড়াশোনা করাতে তার বাবার কাছে অনুমতি চাইলেন। অভাব অনটন ও ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে রাজুর বাবা সম্মতি দিলেন।
জুঁই’র আম্মু রাজুকে ঢাকায় এনে নামকরা একটি স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দিলেন। প্রথমে শিক্ষকরা তাকে অপছন্দ করলেও পরে সবাই তাকে বুকে টেনে নিলেন।
কঠোর অধ্যবসায় আর পরিশ্রমের মাধ্যমে স্বপ্ন পূরণের পথে এগুতে থাকে রাজু। ৫ম শ্রেণির পর ৮ম শ্রেণিতেও সে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেল। এরপর এসএসসি ও এইচএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়ে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়। সেখানেও সে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখে। ২য় স্থান পেয়ে সে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়।
অবশেষে জুঁই’র আব্বু-আম্মুর সহযোগিতায় এবং অধ্যবসায় ও কঠোর পরিশ্রমের কাছে হার মেনে এক সময়ের দুঃখী বালক রাজুর স্বপ্ন ডাক্তার হওয়ার মাধ্যমে বাস্তবে রূপ নেয়। স্বপ্ন বাস্তব হওয়ায় সে আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞতা জানায়।
তার মায়ের মত আর কেউ যেন বিনা চিকিৎসায় মারা না যায়, সে জন্য রাজু গ্রামে ফিরে এসে গ্রামের অসহায় দরিদ্র মানুষের সেবা করতে লাগল।

লেখকঃ আলাউদ্দিন
সাংবাদিক, লেখক ও সংগঠক
নাঙ্গলকোট, কুমিল্লা।
মোবাইল- ০১৯১১৫৩৮০৭৯

Check Also

মাদকসন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সরকারকেই জোরালো ভূমিকা নিতে হবে

—-মো. আলীআশরাফ খান লেখার শিরোনাম দেখে হয়তো অনেকেই ভাবতে পারেন, কেনো লেখাটির এমন শিরোনাম দেয়া ...

Leave a Reply