আজকাল আমরা মানুষ এতটাই পাষা-তার, হীনতার ও উগ্রতার পথে পা বাড়িয়েছি যে, যা আমাদের মানুষ নামের সংজ্ঞা থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। আমরা মানুষ হয়ে অমানুষের মত এমন কোন কাজ নেই যে যা করি না খানিক যশ-খ্যাতি, ক্ষমতা ও সম্পদের লোভে। হেন হীন কাজ নেই যা আমরা করতে পারি না নিজেদের স্বার্থকে চরিতার্থ করতে। লোভ আমাদেরকে এতটাই হিংর করে তুলছে যে, আমরা আপনজনদেরকেও হত্যা করতে কোন রকম দ্বিধাবোধ করছি না। এভাবেই আমরা দিন যতই অতিবাহিত হচ্ছে ততই এক বিভীষিকাময় এবং অন্ধকারের পথে এগিয়ে যাচ্ছি।
এমনই একটি লোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছে কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দিতে। গত ১৩ র্মাচ দিবাগত রাতে উপজেলার বিটেশ্বর ইউনিয়নের খানেবাড়ি গ্রামের বিলকিছ নামের এক মহিলাকে সম্পদের লোভে তারই চাচাত ভাইয়েরা নির্মমভাবে হত্যা করে পার্শ্ববর্তী শুকনো খালের মাটিতে পুঁতে রাখে। এলাকাবাসী এবং বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, পিতা-মাতা ও স্বামী হারা বিলকিছ আক্তার ও ছালেহা আক্তার এই দুই বোন পৈত্রিক বসত বাড়িতে বসবাস করতেন। বিলকিছের পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া প্রায় ৫২ শতক জমিতে বিলকিছদের বাড়ির সম্পর্কে চাচাত ভাই সহীদ গংয়েরা ওই জমি দীর্ঘদিন যাবৎ নানান কৌশলে দখল করার পাঁয়তারা করে আসছে বলে এলাকাবাসী জানায়। এমনকি তাদের জমি সংক্রান্ত বিরোধের ব্যাপারে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা দু’পক্ষকে নিয়ে কয়েক বারই শালিসে বসেছিল। ওই শালিসে সহীদ গংয়েরা তাদের দাবির পক্ষে কোন প্রমাণাদি দেখাতে পারেনি।
এমতাবস্থায় গত ২০০৭ সালে বিলকিছের অসুস্থ বোন ছালেহাকে তার ওই চাচাতো ভাইয়েরা তাদের ঘরে হাত পা বেঁধে মুখে বড় একটা আলু ঢুকিয়ে আঁটকিয়ে রাখে এবং বিলকিছদের বসত ঘর ভেঙ্গে নিয়ে যায়। এই খবর পেয়ে এলাকার মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে এবং তার বোন বিলকিছও বিচারপ্রার্থী হয়ে থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। কিন্তু এলাকার কিছু প্রভাবশালীদের অনুরোধে মামলাটি বেশী এগোতে পারেনি। তারা আশ্বাস দেয়, এলাকার এ ঘটনা শালিসের মাধ্যমে মিমাংসা করে দেয়া হবে। অপরদিকে বড় বোন ছালেহাকে এদিক ওদিক খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে ঘটনার প্রায় ২৪ ঘন্টা পর সহীদের বসত ঘরে হাত পা বাঁধা অবস্থায় বিলকিছ দেখতে পায়। সাথে সাথে ওয়ার্ড মেম্বার আনিসুর রহমান ইখতিয়ারকে ব্যাপারটি অবগত করলে তিনি এসে ছালেহার হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দেন এবং ছোঁরা দিয়ে আলু কেটে ছালেহার মুখ থেকে বের করে আনেন।
জানা যায়, ছালেহাকে হাত-পা বেঁধে তারা অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে ছিল এবং ঐ নির্যাতনের কারণেই প্রায় তিন মাস পর ছালেহা মৃত্যুবরণ করে। ঘরভাঙ্গার ঘটনায় শালিসের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হয় আসামিরা বিলকিছদের ঘর নির্মাণ করে দিবে এবং জরিমানা বাবদ ১ (এক) লাখ টাকা দেয়া হবে। পরে ঘর তুলে দিলেও জরিমানার টাকা দেয়নি তারা। ওই ঘটনার প্রায় ৬ বছর পর গত ১৩ মার্চ দিবাগত রাতের পর ১৪ মার্চ সকাল থেকেই বিলকিছকে আর কেউ দেখেনি এবং তাদের ঘরটি ছিল তালাবদ্ধ। বিলকিছের বোনেরা বিলকিছকে ফোন করে মাঝে মাঝে খবর নিত। বিলকিছ নিখোঁজ হওয়ার পর তার মোবাইলও বন্ধ পায় তারা। এমতাবস্থায় বিলকিছের ভাই ও বোনেরা ১৬ মার্চ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বাড়িতে এসে তালা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকে দেখতে পায়, বিলকিছের ঘর এলোমেলো অবস্থায় পড়ে আছে। হাঁস-মুরগির বাচ্চাও মারা গেছে এবং একটি ছোট ভাতের হাড়িতে ধোয়া কিছু চাল দেখতে পায় তারা এবং বালিশের একটি কভার ও প্রায় এক সপ্তাহ পূর্বে বোন সাবিনার দেয়া একটি নতুন গামছা ঘরে নেই। তাতে তাদের সন্দেহ হয় এবং ওই দিনই দাউদকান্দি থানায় গিয়ে প্রথমে একটি নিখোঁজ হওয়ার সাধারণ ডায়েরি করে। যার নং ৫৯৮।
বিলকিছ নিখোঁজ হওয়ার প্রায় ১০/১২দিন পূর্বে আসামী নুরুল ইসলামের স্ত্রী তাজমহল বিলকিছকে বলেছিল, ‘তুই যে এত লাকড়ি জমা করছিস এই লাকড়ির ভাত খেয়ে যেতে পারবি?’। বিলকিছ এই কথাটি ফোনে তার বোনদেরকে জানিয়েছে এবং বলেছিল, ‘তোরা বাড়িতে আয়, আমার কেমন যেন ডর লাগে।’ বিলকিছের ভাই-বোনেরা নিশ্চিত যে, তার বোনকে সহীদ গংরাই হত্যা করে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে। বিলকিছের বোনেরা অনেক খোঁজাখুঁজি করে কোথাও না পেয়ে হতাশ হয়ে যায়। অপরদিকে আসামীরা বলে বেড়ায়, ‘বিলকিছ কোন্্ বেটার সাথে ভেগে গেছে কে জানে’ ইত্যাদি।
অথচ এলাকাবাসী জানায়, বিলকিছ ভয়-ভীতির মধ্যেই একাকী তার জীবন কাটাত। তার এক চোখ অন্ধ ছিল এবং ডান হাত ছিল অবশ। সন্ধ্যার পরপরই ঘরের দরজা বন্ধ করে দিত। তার প্রাকৃতিক কাজকর্ম ঘরেই সম্পন্ন করতেন। কারো সাথে প্রয়োজন ব্যতীত কোন কথা বলতেন না। গরীব ও অসহায় বিলকিছের ভাই-বোনেরা আল্লাহর উপর বিচারের ভার দিয়ে যে যার কর্মস্থলে চলে যায়। এমতাবস্থায় এলাকায় তিন/চার দিনের ব্যবধানে দু’দিন অঝোরধারে বৃষ্টি হয়। বিলকিছের লাশ যে শুকনো খালে পূঁতে রেখেছিল, সে খালেও প্রায় হাঁটু সমান পানি জমা হয়। লাশ তখন পানি পেয়ে ফুলে উঠে এবং মাটির নীচ থেকে পানির উপরে ভেসে উঠে। ২৩ মার্চ সকাল বেলায় পথচারী লিটন প্রথমে লাশটি দেখতে পায় এবং এলাকার মেম্বারকে জানায়। খবর পেয়ে এলাকাবাসী ঘটনাস্থলে যায় এবং থানায় খবর দেয়। অপরদিকে আসামীরাও পালিয়ে যায়। এমতাবস্থায় আসামী নুরুল ইসলামের স্ত্রী তাজমহলকে জনগণ আটক করে পুলিশের হাতে সোপর্দ করে। পুলিশ লাশ ময়না তদন্তের জন্য কুমিল্লা পাঠায় এবং ৬ জনকে আসামী করে একটি মামলা দায়ের করে। মামলাটির নং ২৫। কিন্তু পুলিশ আসামীদের ধরার ব্যাপারে রহস্যজনক ভূমিকা পালন করছে বলে এলাকাবাসী জানায়।
এই হত্যাকান্ডের আরও নির্মমতা হলো বিলকিছকে তার ব্যবহৃত ওড়না গলায় পেঁচিয়ে তাকে শ্বাসরুদ্ধ করা হয় এবং তার ব্যবহৃত ওই হারিয়ে যাওয়া বালিশের কভারটি তার মুখে ঢুকিয়ে লোহার রড বা শাবাল জাতীয় কিছু দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার পেটের ভিতরে ঢুকানো হয়। ময়না তদন্তের সময় তার পেটের ভিতর থেকে এসব বের করা হয় এবং শাবালের আঘাতে যে তার জিহ্বা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তা প্রতিয়মান হয়। আসামীরা এখানেই ক্ষান্ত হয়নি, বিলকিছের লাশ খালের মাটির গর্তে রাখার পর তার দুই হাত ও দুই পা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ছিদ্র করে মাটিতে শক্ত করে পূঁতে দিয়েছিল যাতে বৃষ্টি হলেও লাশ যেন ভেসে উঠতে না পারে।
কিন্তু এই লোমহর্ষক ঘটনাটি ঘিরে প্রসাশনের ভূমিকা নিয়ে জনমনে নানান প্রশ্ন দেখা দেয়। এলাকাবাসী মনে করে, টাকার কাছে বিক্রি হয়ে গেছে প্রশাসন। আর তা না হলে এমন একটি বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের ব্যাপারে প্রশাসন নীরব থাকবে কেন? এটি তাদের এখন প্রশ্ন। যে কারণে এলাকাবাসী ও স্থানীয় ভূমিহীন সমিতি এ হত্যার বিচারের দাবিতে আন্দোলন করছে। তারা ‘বিলকিছ হত্যা মামলার পর্যবেক্ষণ কামিটি’ নামে একটি কমিটিও গঠন করেছে এবং বিস্তারিত উল্লেখ করে গণস্বাক্ষরসহ লিখিতভাবে প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বরাবরে প্রেরণ করেছেন। কিন্তু এখনও তেমন কোন সাড়া পাননি বলে তারা জানান।
এখন কথা হলো, এই যে পৈশাচিক ও নির্মম হত্যাকান্ডের ঘটনাটি কি প্রমাণ করে না, আমরা মানুষ কতটা নিচে নেমে গেছি? আসলে এই অসভ্য কর্মকান্ডের প্রতি ঘৃণা করার ভাষা আমাদের জানা নেই। আমরা ধিক্কার জানাই ওইসব নরপশুদের যারা সম্পদের লোভে পরপর দু’টি নারীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। সরকারের কাছে আমাদের আবেদন, যাতে এই ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় এবং আর কোন অসহায় মানুষের যাতে এরূপ নিষ্ঠুরতার স্বীকার হতে না হয। আইনের শাসন সমাজে প্রতিষ্ঠা পাক-এটাই আমাদের দাবি সরকারের প্রতি। অপরাধী যেই হোক, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে সমাজে অপরাধ প্রবণতা ধীরে ধীরে কমে আসবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
লেখক: কবি, কলামিস্ট ও সংগঠক
গৌরীপুর, দাউদকান্দি, কুমিল্লা।