মানুষ জন্মলাভের পর যে ভাষা শুনতে পায় সেটি তার মায়ের ভাষা-মাতৃভাষা। এ মধুর ভাষার কোন তুলনা হয় না। হতে পারে না। মায়ের এ ভাষা প্রত্যেক মানুষের জন্যই অমূল্য সম্পদ। এ সম্পদ-মাতৃভাষাকে টিকিয়ে রাখা, যথাযথভাবে ব্যবহার করা এবং সম্মান দেখানো প্রত্যেক সচেতন মানুষেরই দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ দায়িত্ব ও কর্তব্যকে যারা অবহেলা করে তারা কখনও উন্নতি লাভ করতে পারে না। মানুষের জন্য ভাষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম। প্রতিমূহূর্তের স্পন্দন ও প্রবাহের মধ্যদিয়ে তার জীবিত ও জাগ্রত সত্তাকে অস্তিত্বময় ও প্রাণান্ত করার ক্ষেত্রে ভাষার কোন বিকল্প নেই। মানুষকে বৈচিত্রতার সমাহারে নান্দনিক উপস্থাপন, অস্তিত্ব, অবস্থান, গতি-প্রগতি, শক্তির সমন্বয় ও রচনাকে সমৃদ্ধ করে ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমে। ভাষার বেগ-চালনায় দেহে শক্তির সঞ্চার হয়, অঙ্গ-প্রতঙ্গ সঞ্চালিত হয়, মস্তিষ্ক কোটর, চেতনা-চৈতন্য, স্মৃতিকোষ, অনুভূতি-উপলব্দির ক্রিয়া সম্পন্নতায় বোধগম্যের সৃষ্টি হয়। এককথায়, ভাষা মানুষের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
আধুনিক বিশ্বে আমাদেরকে সুন্দর ও উন্নতভাবে জীবন-যাপন করার প্রয়োজনে একাধিক ভাষা জানা অত্যাবশ্যক। এর মধ্যে সর্বাগ্রে মাতৃভাষার গুরুত্বই সবচেয়ে বেশি। আমাদেরকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে ভাষা ব্যবহৃত হয় এটা আয়ত্বে থাকা যেমন জরুরি তেমনি ধর্মীয় ভাষার উপর দখল থাকা আরো বেশি প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। এককথায় মাতৃভাষা, ধর্মীয় ভাষা ও সর্বজনবিদিত ভাষা চর্চার মধ্যদিয়েই একজন মানুষ জানাশোনার পরিধিকে সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হয়। এবং বিশ্বে নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। তবে যে যাই বলুক, মানুষ তার মাতৃভাষা সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞানার্জন না করতে পারলে কোনোকালেই উন্নত হতে পারে না। নিজ ভাষার আদ্যপ্রান্ত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অবগত না হলে কোন ব্যক্তি-গোষ্ঠি-জাতির উন্নতি অসম্ভব। মন থেকে গ্রহণ ও আন্তরিকতা এবং দরদের সাথে নিজ ভাষার ধারাবাহিক অনুশীলনই স্ব-জাতির উন্নতি বিধান সম্ভবপর হয়ে উঠে। কারণ, ভাষা চর্চার মাধ্যমেই মানবজীবনের অতি প্রয়োজনীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতির সর্বোত্তম পন্থাটির বিস্তৃতি ঘটে; ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্বাক্ষর বহন করে নিজ নিজ শিল্পকর্মের অগ্রগতি সাধিত হয়। এটা শুধু বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেই নয়, প্রত্যেক ভাষার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। একমাত্র যার যার মাতৃভাষা-সহজবোধ্যতার জন্যই নিজ নিজ ভাষা চর্চার ফলে এটি সহজতর হয়ে ওঠে। আর এ জন্যই মানুষ তার নিজস্বতাকে কোন ব্যক্তি-জাতি-গোষ্ঠী দ্বারা পদদলিত হতে দেখলে গর্জে ওঠে।
তেমনি আমাদের ভাষা বাংলা-মায়ের ভাষার ওপর যখন আক্রমণ আসে তখন সমগ্র ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঝাঁপিয়ে একই সুরে উচ্চারণ করেছিল,‘আমরা বাংলা চাই-বাংলা চাই’। মায়ের ভাষা বাংলা ভাষার দরদে রক্ত দিয়েছিল বাংলার সাহসী একঝাঁক তরুণ। সংগ্রাম করে ছিনিয়ে এনেছিল মায়ের ভাষা বাংলাকে আমাদের ভাষাপ্রেমিক-দেশপ্রেমিক প্রকৃত দেশরতœরা। তারা মা-মাতৃভাষার ওপর আঘাত সহ্য করতে পারেনি। মেনে নিতে পারেনি অযৌক্তিকভাবে চাপিয়ে দেয়া অন্য ভাষাকে। তারা প্রতিবাদ করেছিল সর্বশক্তি দিয়ে। নজিরবিহীন দৃষ্টান্তস্থাপন করেছিল সেইদিন পূর্ব বাংলায় ভাষা আন্দোলনে ডাক দিয়ে। বাংলা মায়ের বীর সেনানীরা নিজ ভাষা বাংলাকে রক্ষা এবং মাতৃভাষা রূপে আলিঙ্গন করতে ’৫২-এর ফেব্রুয়ারিতে আন্দোলন শুরু করে। যার ফলশ্রুতিতে বাংলার সূর্য সন্তানদের দ্বারা অর্জিত হয় এই ‘২১ ফেব্রুয়ারি’ আজকের মহান আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা বাংলা। সেইদিন সফলতার সঙ্গে অর্জন করে আমাদের তরুণরা গৌরবগাঁথা এ অধ্যায়, সৃষ্টি করে এক নবতর উজ্জ্বল ইতিহাস।
এরপর কেটে যায় দীর্ঘ সময়। আমরা বহু কন্টকাকির্ণ পথ পেরিয়ে অনেক সংগ্রাম, চড়াই উৎড়াই, যুদ্ধ-বিগৃহ, হত্যা, ধর্ষণ, দুর্ভিক্ষ, খরা-দারিদ্র, জলোচ্ছ্বাস-টর্নেডো, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অপরাজনীতি, অপশাসন ও বিদেশি অপশক্তির হিংস্র থাবা থেকে মাথা সুউন্নত করে সামনে এগিয়ে চলেছি। কখনও কারো কাছে মাথা নত করেনি এই বাঙালি বীরের জাতি। শত বাঁধা-বিপত্তি ডিঙিয়ে আমাদের ভাষাপ্রেমিক, দেশপ্রেমিক মানুষেরা যুগে যুগে ভাষার জন্য দেশের জন্য নিরলস সংগ্রাম করেছেন, করছেন। আমরা তাদেরকে এমন মহৎ-মহান ও কালজয়ী অর্জনের জন্য বিনম্্র চিত্তে সম্মান জানাই, জানাই গভীর শ্রদ্ধা। কিন্তু দু:খের বিষয়, আজ দেশের তৃণমূল পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়েও এমন কিছু মানুষ রয়েছেন যাদের ভাষার প্রতি অবজ্ঞা-অবহেলা, ভাষাসৈনিকদের অসম্মান আমাদেরকে লজ্জায় ফেলে দেয়।
আমরা এতটাই হতভাগ্য জাতি যে, আজ ৬১ বছর পরেও প্রকৃত ভাষাশহীদ, ভাষাসৈনিক এবং দেশপ্রেমিকদের যথাযথ মূল্যায়ন করতে সক্ষম হইনি। দেশে যেসব ভাষাসৈনিক-দেশপ্রেমিক রয়েছেন তাদেরকে পারছিনা জাতীয়ভাবে সম্মান প্রদর্শণ করে জাতির কিছুটা হলেও ঋণ মুক্ত করতে। আমরা বছরের বিশেষ কোন একটি দিনকে উদ্যাপনের লক্ষ্যে বেশ বড়সড় আয়োজন করি। রঙবেরঙে বাহারি সাজে সাজাই শহীদ মিনার। তোড়ন-মঞ্চ বানিয়ে এবং সভা-সমাবেশের আয়োজন করে আমরা প্রমাণ করতে চাই ভাষার প্রতি আমাদের অনেক দরদ অনেক ভালোবাসার! আসলেই কি এসব কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে ভাষাপ্রেম-দেশপ্রেম ও সৃষ্টিশীলদের প্রতি সম্মান দেখানো হয়? আমরা তো মনে করি, তা চরম অমর্যাদারই বহি:প্রকাশ ঘটায়। এছাড়া আমাদের দেশের প্রায় সর্বক্ষেত্রে ভাষার প্রতি যে উদাসীনতা এবং অবহেলা এটাই প্রমাণ করে, আমরা ভাষার প্রতি এখনও আন্তরিক হতে পারিনি। আমাদের চলায়-বলায়, পোশাক-পরিচ্ছদসহ যাবতীয় কর্মকান্ডে বাঙালিত্বের লেশমাত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। আমরা কথায়কথায় অশুদ্ধ বাংলা, ক্ষেত্রে অক্ষেত্রে অশুদ্ধ ইংরেজির ব্যবহার করে নিজেরা উন্নত হয়েছি বলে জাহির করতে চাই। মহান সংসদে এমন কিছু অশোভন অশ্রাব্য, প্রতিহিংসাপরায়ণ, অশ্ল¬ীল, অশুদ্ধ ও জগাখিচুরী মার্কা বাংলা-ইংরেজি বাক্য ব্যবহার করি এবং আমাদের রেডিও চ্যানেলগুলোয় আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে ব্যাঙ্গ করে উপস্থাপন করা হয়। যা পুরু জাতিকে চরম লজ্জায় পর্যবসিত করে।
আমরা মনে করি, এবারের মহান ’২১ উদযাপনের মধ্যদিয়ে দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সকল কর্মকর্তাগণ এবং সকল অফিস-আদালতে ভিনদেশী ভাষা ব্যতিরেকে আমাদের বাংলা ভাষার প্রচলন শুরু হবে। আজ যেখানে আমাদের বাংলা ভাষাকে নিয়ে জাতিসংঘ পর্যন্ত গর্ববোধ করে সেখানে আমাদের মধ্যে হীনমন্যতা থাকা কি লজ্জার নয়? এখন জাতির সময়ের দাবি, আমাদেরকে যথাযোগ্য মর্যাদায় মহান ২১ ফেব্রুয়ারিকে হৃদয় থেকে গ্রহণ করতে হবে।। ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবে পালন করলেই চলবে না, প্রমাণ করতে হবে আমাদের আচার-আচরণ ও ভাষা ব্যবহারের মধ্যদিয়ে আসলেই বাঙালি জাতি হিসেবে আমরা উন্নত হয়েছি, পরিশুদ্ধতার পথে এগিয়ে চলছি। আমাদেরকে ভুলে গেলে চলবে না, মাতৃভাষার যথাযথ চর্চা ব্যতীত কোন জাতি উন্নত হয় না। মাতৃভাষার সঠিক চর্চার মধ্য দিয়েই জাতি উন্নতি লাভ করে, দেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় বিশ্বসভায়।
লেখক: কবি, কলামিস্ট ও প্রবন্ধকার
গৌরীপুর, দাউদকান্দি, কুমিল্লা।