সরাইল / ৬ ডিসেম্বর (কুমিল্লাওয়েব ডটকম)———
সরাইল উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে তেলিকান্দি গ্রাম। পাশেই নাসিরনগর উপজেলার সীমানা। তেলিকান্দি গ্রামে এখন পুড়া গন্ধ। ধ্বংস্তুপে দাঁড়িয়ে ক্ষতিগ্রস্থদের কান্নার রোল। প্রতিপক্ষের দেওয়া আগুনে কেউ হারিয়েছেন বাড়িঘর কেউবা শেষ সম্বল। কেউবা আশঙ্কা করছেন স্বজন পুড়ে মারা যাওয়ার। আবারো হামলার শঙ্কায় বাড়ি ছেড়েছেন এলাকার পুরুষরা। পুরো গ্রামে এখন হাহাকার।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, আসমা বেগম ও মালেকা বেগম নামে দুই নারী কখনো বাকরুদ্ধ, কখনো হাউমাউ করে কেঁদে উঠছেন। তাদের কান্না সন্তানের জন্য। পুড়ে যাওয়া ঘরের নীচে তাঁরা খুঁজে ফিরছেন সন্তানকে। আসমা বেগমের তিন বছরের মেয়ে আঙ্গুরা ও মালেকা বেগমের চার বছরের ছেলে রহিমের খোঁজ মিলছে না বুধবার রাত থেকে।
এলাকাবাসী জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার পাকশিমুল ইউনিয়নের তেলকান্দি গ্রামে সংঘর্ষের ঘটনায় আহত ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি মো. নূরু মিয়া ভূইঁয়ার মৃত্যুর জের ধরে বুধবার সন্ধ্যায় শুরু করে বৃহস্পতিবার ভোরসকাল পর্যন্ত দফায় দফায় চলে তান্ডব। প্রতিপক্ষের অন্তত ২০টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় প্রতিপক্ষের হামলায় নারীসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়।
গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সহকারি পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) শাহ আলম বাকাউলের নেতৃত্বে পুলিশ গ্রামে অবস্থান করছে।
এলাকার লোকজন জানান, নৌকা পারাপার নিয়ে বিবাদের জের ধরে গত ২ নভেম্বর তেলিকান্দি গ্রামের হামিদ মিয়া ও কালাম মিয়ার লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে গুরুতর আহত হামিদ মিয়ার পক্ষের নূরু মিয়া ভূইঁয়া গত বুধবার দুপুরে ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এ খবর গ্রামে পৌঁছলে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। প্রথমে বুধবার সন্ধ্যায় ও পরে রাতে এবং গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে কালাম মিয়ার পক্ষের লোকজনের বাড়িতে হামলা চালানো হয়।
এ সময় প্রতিপক্ষের দেওয়া আগুনে ইদ্রিস সরদার, ইজ্জত আলী, মাওলানা সমুজ আলী, সুলতান মিয়া, দুলাল মিয়া, সিরাজ মিয়া ও মোতালেব মিয়ার ১১টি ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এছাড়া লুটপাট চালানো হয় কালা মিয়া, আসীম মিয়া, কুতুব মিয়া, তৈয়ব আলী, ইউনুস মিয়া, আরু মিয়ার ঘরে। ঘটনার পর থেকে দুলাল মিয়ার মেয়ে আঙ্গুরা ও সুলতান মিয়ার ছেলে রহিমের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ইজ্জত আলীর একটি গরু আগুনে পুড়ে ও দুলাল মিয়ার গরু পানিতে ডুবে মারা যায়। এছাড়া গ্রামের লোকদের আরো অন্তত ১৪টি গরু লুট হয়।
গ্রামে ঢুকেই কথা হয় ইজ্জত আলীর স্ত্রী নূরজাহান বেগমের (৫০) সঙ্গে। তিনি কাঁদছেন। আশা ছিল আর কয়দিন পরই একমাত্র গাভীটি বাছুর প্রসব করে দুধ দিতে শুরু করবে। দুধ বিক্রি করার টাকায় সংসারে ফিরাবেন স্বচ্ছলতা- এমন স্বপ্নই ছিল নূরজাহান বেগমের। কিন্তু প্রতিপক্ষের দেওয়া আগুনে তাঁর একমাত্র গাভীটি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
পাকশিমুল ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য (মেম্বার) মো. কামাল মিয়া বলেন, ’আমার বয়সে আমি এত বড় তান্ডব দেখিনি। এটি ন্যাক্কারজন ঘটনা। ঘটনার সঙ্গে জড়িতেদের বিচার চাই’।
পাকশিমুল ইউপির চেয়ারম্যান কাজী মোজাম্মেল হক জানান, আহত ব্যক্তির মৃত্যুর পর বেশ কিছু বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর থেকে দুই শিশুর খোঁজ মিলছেনা। তবে পরিস্থিতি এখন শান্ত আছে।
অরুয়াইল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো.আছহাব উদ্দিন জানান, বুধবার আহত ব্যক্তির মৃত্যুর খবর পেয়ে আমরা সেখানে যাই। এ সময় বাড়িঘরে আগুন দিলে লোকজনকে নিয়ে আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনার চেষ্টা করি। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়।
ঘটনাস্থলে থাকা সরাইল থানার উপ-পরিদর্শক (এস.আই) মো. ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, ’গ্রামের পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষনে আমরা সেখানে অবস্থান করছি। দুই শিশু নিখোঁজ রয়েছে বলে আমাদেরকে জানানো হয়েছে’।
সরাইল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) উত্তম কুমার চক্রবর্তী জানান, ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। সংঘর্ষের ঘটনায় আগেই একটি মামলা হয়েছে। তবে নতুন করে হামলার ঘটনায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা নাগাদ কেউ মামলা দেয়নি।
(আরিফুল ইসলাম সুমন, তেলিকান্দি গ্রাম থেকে ফিরে )