এসিডসন্ত্রাসের শিকার ফারজানার মৃত্যু ও আমাদের বিবেক ——–মো. আলী আশরাফ খান


মনটা ভীষণ খারাপ। গত রাতে একটুও ঘুমাতে পারিনি। রাত এগারোটায় ছেলে ফয়সালের বন্ধু কাউছারের অসুস্থতা এবং স্ত্রীর শরীর খারাপের ব্যাপারটি আমাকেও অসুস্থ করে ফেলে। পরের দিন সকাল অর্থাৎ ৩ ডিসেম্বর একটু দেরি হয়ে গেল বাসা থেকে বের হতে। অফিসে বসে কথা বলছিলাম, সাংবাদিক আব্দুস ছালাম ভাইয়ের সঙ্গে। যদিও দাউদকান্দি উদ্দীপনে শিশু অধিকার বিষয়ে একটি অনুষ্ঠানের দাওয়াত ছিল। কিন্তু শরীরটা ভালো লাগছিল না বলে যাওয়া হইনি। ঠিক এমন সময় মুঠোফোনে ফারজানার মৃত্যুর খবরটি এলো। বিমর্ষ হয়ে গেলাম। যেনো বোধশক্তি হারিয়ে ফেললাম। বসা থেকে উঠতে পারছিলাম না। ছালাম ভাই আমাকে ধরে তুললেন। আমার শরীর কাঁপছে। কথা বলার কোনো ভাষা নেই। সোজা বাসায় চলে গেলাম। বহু চেষ্টা করলাম এ ব্যাপারে কিছু লেখার জন্য। সম্ভব হলো না। পরে ফারজানার বড় ভাইকে ফোন দিলাম। ফারজানার লাশ বাড়িতে কখন আসবে তা তিনি জানাতে পারলেন না। সারারাত ঘুমাতে পারিনি। শুধু ফারজানার মায়াময় ছবিটি ভেসে ওঠেছে আমার হৃদয়ে।
৪ ডিসেম্বর রীতিমত সকালে বাসা থেকে বের হয়ে অফিসে বসে পত্রিকা পড়ছিলাম। এমন সময় এক সাংবাদিক ফোন দিয়ে বললেন, ফারজানার লাশ বাড়িতে এসে পৌঁছেছে। খবরটি শোনার পর এক মুহুর্তও দেরি করিনি। মটরবাইকে করে ফারজানাদের বাড়িতে পৌঁছতে যতক্ষণ সময়। গিয়ে দেখি, ফারজানার ক্ষত-বিক্ষত লাশ দাফন সম্পন্ন হয়ে গেছে। আমাদেরকে দেখে ফারজানার ভাই-বোন এসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তাদের কান্না দেখে আমরাও চোখের জল সংবরণ করতে পারলাম না। কোনো মতে চোখ মুছে দাঁড়িয়ে ছিলাম কলাগাছের আঁড়ালে। তারপরেও অপর দুইজন এসিডদগ্ধদের সঙ্গে কথা বললাম এবং তাদের ফটো তোলা হল। বিশেষ করে ফয়সাল মাহমুদের অবস্থা বেশি খারাপ। দগদগে ঘা-ক্ষত দেখে যে কারো শরীর শিউরে ওঠার মতো।
ফারজানার অকাল মৃত্যুর শোকে হাজার হাজার মানুষ মুহ্যমান। চারদিকে আহাজারি। মহিলারা কেউ কেউ বুক চাপড়াচ্ছেন। উপস্থিত সকলের চোখ পানিতে ঢলমল করছে। এমন সময় কয়েক জন লোক উচ্চকন্ঠে বলতে শুরু করলেন, ‘আমরা ফারজানার খুনীদের ফাঁসি চাই’। তাদের গলার শব্দ শোনে উপন্থিত সকলই বলতে লাগলেন, ‘ফারজানার খুনীদের ফাঁসি চাই-ফাঁসি চাই, ফারজানার খুনীদের ফাঁসি চাই’। তৎক্ষণাৎ শত শত লোক জড়ো হয়ে বজ্রকন্ঠে ফাঁসি চাই-ফাঁসি চাই শ্লোগান দিতে দিতে দাউদকান্দি-মতলব সড়কের দিকে রওনা হন। ততক্ষণে হাজার হাজার মানুষ ওই মিছিলে যোগ দিয়ে তাদের দাবির প্রতি সমর্থন জানান। সকলের সুর এক হয়ে ধ্বনিত হয়, ‘ফাঁসি চাই-ফাঁসি চাই, ফারজানার খুনীদের ফাঁসি চাই’।
আমার মনটা খুব আনচান করছিলো। ইচ্ছে করছিল, ফারজানার কবরটিকে জিয়ারত করে যাই। আমার সঙ্গে থাকা সাংবাদিক শরীফকে বলার পর সেও সম্মতি জানাল। ফারজানাদের বাড়ি থেকে একটু দূরে ওই কবরস্থান। আমরা চলে গেলাম কবরস্থানে। যখন মোনাজাত এবং ফারজানার রুহের মাগফেরাত কামনা করছিলাম, তখন কবর পাড়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে বড়ই অপরাধী মনে হয়েছিল। একজন নিস্পাপ বালিকা আজ চলে গেল পৃথিবী ছেড়ে। এ সমাজ তাকে বাঁচতে দিলো না। এমন এক নির্দয় আচরণ করলো তার সঙ্গে যার ভাষা নেই! আমরাও তো এ সমাজেরই মানুষ, আমরা তাকে সুস্থভাবে বাঁচার জন্য কতটুকু পরিবেশ নিশ্চিত করতে পেরেছিলাম। আমরা কি সমাজের বখাটেদের নির্মূলে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছিলাম? এসব প্রশ্ন বারংবার আমার বিবেককে আঘাত করেছিল। কবরন্থান ছেড়ে আসার সময় দুইজন মুরব্বির সঙ্গে দেখা হলো। তারা আমাদের সঙ্গে কথা বললেন ফারজানার ব্যাপারে। ওই গ্রামেরই বাসিন্দা আঃ রব (৭৫)। তিনি বলেন, ‘ফারজানা খুব ভালা মাইয়া ছিলো। পড়ালেহা ও নামাজ কালামও পড়তো মাইডা’। মোঃ গিয়াস উদ্দিন(৫৫)। তিনি চিৎকার করে বলেন,‘ এ মাইয়াডার মতো মাইয়াই অয়না। পর্দাপশিদায় পাক্কা মাইয়াডারে যারা মারছে আমরা দাগো ফাঁসি চাই’।
এবার মূল বিষয়টি এখানে উপস্থাপন করা দরকার। গত ১১ নভেম্বর গভীর রাতে দাউদকান্দি উপজেলার সোনাকান্দা গ্রামের জালাল উদ্দিনের কন্যা ফারজানা আক্তার (১৫), তার ভাগ্নে ফয়সাল মাহমুদ (১০) ও কাজের মেয়ে খাদিজা আক্তার (১৭) কে ঘুমন্ত অবস্থায় কিছু বখাটে এসিড ছুঁড়ে মারে। এসিডদগ্ধদের অপরাধ সোনাকান্দা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ইসলামিয়া-রহমানিয়া দাখিল মাদরাসার নবম শ্রেণীর ছাত্রী ফারজানা আক্তার বখাটেদের কথিত প্রেমের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। ফারাজানা হয়তো বুঝতে পারেনি, এ বখাটের দল তাকে চিরতরে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দেবেন। যদিও বখাটে সাদ্দাম ও শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন প্রায়ই বলতেন, ‘ফারজানাকে আমরা এমন কঠিন শাস্তি দেবো, যেন তার দিকে কেউ চোখ তুলেও না তাকায়; কোনো পুরুষ যেনো তাকে বিয়ে না করে’।
এ কথিত প্রেমের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়াই কাল হলো ফারজানার। এজন্য তাকে এতটাই কঠিন মূল্য দিতে হলো যে, শেষ পর্যন্ত জীবনটাই খোয়া গেল। ২২ দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্ছা লড়ে ফারজানা অবশেষে জানান দিলো, এ সমাজ-দেশ-জাতি ব্যর্থ ও পরাজিত এসব বখাটে-সন্ত্রাসীদের কাছে। ৩ ডিসেম্বর সোমবার সকাল সাড়ে এগারোটায় ঢাকার ধানমন্ডি সেন্ট্রাল প্রাইভেট হাসপতালে তিন দিন লাইফ সার্পোটে থাকার পর ফারজানা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন। এ মৃত্যুর মধ্যদিয়ে আমাদের সমগ্র জাতিকে চরম লজ্জার সাগরে ডুবালেন তিনি। স্থানীয় বখাটে সাদ্দাম হোসেন ও তার মাদরাসার সাবেক শিক্ষক দেলোয়ার হোসেনের প্্েরমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় তাকে এ মাসুল দিতে হলো। এসিডসন্ত্রাসিরা এতই পাষা- ও ধূর্র্ত যে, এসিড নিক্ষেপের পূর্বে তারা বাড়ির পানির ট্যাঙ্ক, কলস,ঘটিবাটির সকল পানি কৌশলে সরিয়ে ফেলেন। যে কারণে কোনো পানিই দেয়া সম্ভব হয়নি এসিডদগ্ধদের। এছাড়া ফারজানার শরীরের প্রায় ৭০ ভাগ অংশ এসিডে ঝলছে বীভৎস রূপ ধারণ করে।
এখন আমাদের প্রশ্ন, এ এসিডসন্ত্রাসীরা কি আসলেই মানুষ? তাদের কি বিবেক বলতে কিছু আছে? এমন নির্দয়-নির্মম ও পাষ- হয়ে কি করে মানুষ! কি করে এমন ফুলের মত তিনটি কোমল প্রাণের ওপর এসিড নিক্ষেপ করতে পারলো ওরা। ফুল না ফুটতেই ফারজানার মত ফুটফুটে একটি মেয়েকে পাঠিয়ে দিল পরপারে। খাদিজা ও ফয়সালের মত ছোট্ট শিশুকে ঝলছে দিল ভয়াবহ এসিডে। আমাদেরকে আর কত দেখতে হবে এসব বীভৎসতা। এখনও কি সময় হয়নি, এসব বখাটে-সন্ত্রাসীদের রোখার। দেশের সব প্রান্তেই এখন চলছে ইভট্টিজারদের মহড়া, চলছে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। আমাদের মা-বোনেরা আজ কোথাও নিরাপদ নেই। বিশেষ করে উঠতি বয়সী ছেলেরা বেপরোয়া হয়ে যৌনসন্ত্রাস চালাচ্ছে সমাজে। এসব যৌনসন্ত্রাসের ফলে দেশে একেরপর এক কোমল প্রাণ ঝরে যাচ্ছে। যতইদিন যাচ্ছে ততই ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়ছে এ ব্যাধি। বেশির ভাগ বিত্ত বৈভব ও ক্ষমতাসীনদের সন্তানরাই বখাটেপনায় ব্যস্ত। তাদের দাপটে মানুষ এখন দিশেহারা। অনেক সাধারণ অভিভাবক বিয়ের বয়স না হলেও তাদের মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে-এসব বখাটেদের ভয়ে। দিনে দিনে এক ভয়াবহ অবক্ষয়ের দিকে যাচ্ছে সমাজ। আমরা যদি এখনও সামাজিকভাবে প্রতিরোধ না গড়ে তুলি এসব বখাটেদের বিরুদ্ধে, তাহলে কাল হয়তো আমার বোন আপনার স্ত্রী শিকার হবে যৌনসন্ত্রাস বা এসিডসন্ত্রসের।
পরিশেষে আমরা বলবো, আমাদের সকলের বিবেক জাগ্রত হোক। দেশের সকল যৌনসন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠুক বিবেকবানদের আহ্বানে। ফারজানাকে যারা এসিডে পুরিয়ে মারলো এবং দগ্ধ করলো আরো অপর দুইজনকে, তাদের সকলকে অবিলম্বে গ্রেফতার করে ফাঁসিতে ঝুলানো হোক। যাতে করে সমাজের অন্য যৌন ও এসিডসন্ত্রাসীরা বুঝতে পারে এর পরিনাম মৃত্যু।

লেখক: মো. আলী আশরাফ খান
আহ্বায়ক,
ইভটিজিং-যৌনসন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটি (বৃহত্তর দাউদকান্দি)
দাউদকান্দি, কুমিল্লা।

Check Also

মিনি ওয়াক-ইন-সেন্টারের মাধ্যমে রবি’র গ্রাহক সেবা সম্প্রসারণ

ঢাকা :– গ্রাহক সেবাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে মোবাইলফোন অপারেটর রবি আজিয়াটা লিমিটেড সম্প্রতি মিনি ওয়াক ...

Leave a Reply