দাউদকান্দির একটি এসিডসন্ত্রাসের ঘটনা ও প্রাসঙ্গিকতা ——মো. আলী আশরাফ খান

আমি ও সাংবাদিক আবদুর রহমান ঢালী ১২ নভেম্বর সোমবার জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষার দাউদকান্দির একটি কেন্দ্র পাচঁগাছিয়া ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয় পরিদর্শণকালে আমাদের মুঠোফোনে খবর এলো, উপজেলার সোনাকান্দায় একটি এসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। যেহেতু আমি দাউদকান্দি উপজেলা ইভটিজিং প্রতিরোধ কমিটির আহ্বায়ক সেহেতু ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা অতিব জরুরি মনে করে চলে গেলাম ঘটনাস্থলে। আমার সঙ্গে সাংবাদিক আবদুর রহমান ঢালী। আমরা গিয়ে যা জানলাম, সোমবার ভোররাতে উপজেলা পদুয়ার সোনাকান্দা গ্রামে প্্েরমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় মাদরাসা ছাত্রী ফারজানা আক্তারসহ তিনজন ভয়াবহ এসিডসন্ত্রাসের শিকার হয়েছে। মেয়েটির পরিবার সূত্রে জানা গেল, পদুয়া ইউনিয়নের সোনাকান্দা গ্রামের জালাল উদ্দিনের মেয়ে, সোনাকান্দা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন রহমানিয়া দাখিল মাদ্রাসার নবম শ্রেণীর ছাত্রী ফারজানা আক্তার (১৫) কে জামালকান্দি গ্রামের কালু মিয়ার পুত্র বখাটে সাদ্দাম হোসেন (২২) এবং ওই মাদরাসার শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন দীর্ঘদিন যাবত প্্েরমের প্রস্তাব দিয়ে আসছিল।
মেয়েটি প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় সোমবার ভোররাতে ঘুমন্ত অবস্থায় ঘরের জানালা দিয়ে বখাটেরা এসিড নিক্ষেপ করে। এ এসিডসন্ত্রাসের শিকার ফারজানার বোনের ছেলে একই মাদরাসার পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র ফয়সাল মাহমুদ (১০) এবং কাজের মেয়ে খাদিজা আক্তার (১৭) দগ্ধ হয়। ওইসময় তাদের ডাকচিৎকারে পরিবারের সদস্য ও আশেপাশের লোকজন ছুটে আসে এবং তাদের ৩ জনকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নিয়ে যাওয়া হয়। এ ঘটনায় দাউদকান্দি থানা পুলিশ পদুয়া থেকে ৫ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে থানায় নিয়ে আসে। এবং ঘটনার পর থেকে বখাটে সাদ্দাম হোসেন পলাতক রয়েছে বলে জানা যায়। এর পরের দিন এ ভয়াবহ এসেডিসন্ত্রাসের সংবাদটি বেশ ফলাও করে সংবাদ মাধ্যমগুলোয় প্রকাশ পায়।
১৩ নভেম্বর সকালে দেশ টিভি’র কুমিল্লা প্রতিনিধি এম ফিরোজ মিয়া ও ইসলামিক টেলিভিশন’র ওমর ফারুক তাপসসহ আমরা আবার গেলাম সোনাকান্দায় ফারজানাদের বাড়িতে। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে ফারজানার ভাই, বোন, ফুফু ও সহপাঠিদের সঙ্গে কথা হলো এসিডসন্ত্রাসের বিষয়ে। সকলের বুকফাটা কান্নায় পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠছিল। তারা বললেন, ফারজানা যে মাদরাসায় পড়াশোনা করতো সেই মাদরাসার শিক্ষক মোঃ দেলোয়ার হোসেন ফারজানাকে প্রেমের প্রস্তাব এবং পরে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। এতে ফারাজানা অসম্মতি প্রকাশ করলে দেলোয়ার তাকে দেখে নেয়ার হুমকি দেয়। শুধু তাই নয়, দেলোয়ার প্রায় সময় উচ্চকন্ঠে বলতেন, তাকে বিয়ে না করলে ফারজানাকে অন্য কেউ বিয়ে করতে পারবে না। ফারাজানকে এমন কঠিন অবস্থার শিকার হতে হবে , অন্য কোনো পুরুষ যেন তার দিকে ফিরেও না তাকায়। এমনিভাবে জামালকান্দি মোঃ সাদ্দাম হোসেনও রাস্তায় দাঁড়িয়ে মাদরাসায় আসা-যাওয়ার পথে একই কথা বলতেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এই ঘটনাটি ঘটে। সুতরাং এ ঘটনার মূল বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন মহলের বুঝতে বাকি থাকার কথা নয়। এদিকে দেলোয়ার ও সাদ্দাম দু’জনেই পলাতক রয়েছে। আর যে পাঁচজনকে আটক করা হয়েছিল তাদেরকে দাউদকান্দি থানা থেকে কুমিল্লায় প্রেরণ করা হয়েছে।
আমরা এখন এ পদুয়া ও সোনাকান্দার ইভট্টিজারদের বিষয় নিয়ে একটু পিছনে ফিরে যাবো। গত বছর একই মাদরাসার অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী ইয়াসমিন (ছদ্ম নাম) নামের ১৪ বছরের একটি মেয়ে ইভটিজিং-যৌনসন্ত্রাসের শিকার হয়। আমরা নির্যাতীতার অভিভাবকদের অনুরোধে তার সঠিক নাম ঠিকানা এবং যৌনসন্ত্রাসীদের নাম ঠিকানাও প্রকাশ করিনি। ঘটনার দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। খবর পেয়ে আমি ও দাউদকান্দি উপজেলা ইভটিজিং-যৌনহয়রানী প্রতিরোধ কমিটির সদস্য সচিব রাশেদুল ইসলাম লিপু কয়েকেজন সাংবাদিক নিয়ে গিয়েছিলাম সোনাকান্দায়। আলম (ছদ্ম) নামের একভদ্র লোক আমাদেরকে এব্যাপারে সহযোগিতা করেন। মেয়েটির মুখ থেকে ঘটনার বর্ণনা হবহু তুলে ধরা হলো এখানে, ‘আমি প্রতিদিনের মতো মাদরাসার ক্লাস শেষ করে বাড়িতে ফিরছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে যখন পদুয়া-সোনাকান্দা ব্রিজটির ওপরে উঠলাম, ঠিক তখন উত্তর দিক থেকে একটি মটরসাইকেলে করে তিনজন ছেলে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। তারা দুই জন আমাকে ঝাঁপটে ধরে, আরেকজন আমার বোরকার মুখোশ খুলে ফেলে এবং সঙ্গে সঙ্গে মুখ চেপে ধরে ছুরি দিয়ে দুই হাতে আঘাত করতে থাকে। আমি চিৎকার করি কিন্তু তারা মুখ চেপে ধরে রেখেছে বলে কোনো শব্দ বের হচ্ছিল না। আমি ভেবে নিয়েছিলাম, এই বুঝি আমাকে তারা মেরে ফেললো। হঠাৎ উত্তর দিক থেকে একটি সিএনজি আসতে দেখে ওরা আমাকে ছেড়ে মটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়। আমার ভাই দূর থেকে দেখে আমাকে তাড়াতাড়ি বাড়িতে নিয়ে আসে’। এর বেশি কিছু বলতে রাজি হলো না মেয়েটি।
এ ব্যাপারে আমরা ৬-৭ জনের সঙ্গে কথা বলি। স্কুলছাত্র, কলেজছাত্র, ব্যবসায়ী, কৃষক ও গৃহিণী সবার একই কথা-মেয়েটি অতিভদ্র, নামাজ-রোজায় পাকা, সবসময় বোরকা পরে মাদরাসায় যাওয়া-আসা করে। দুই ভদ্রলোক মূল রাস্তা পার হওয়ার পর বললেন,‘ মাদরাসার পাশের দোকানটি রীতিমত বখাটেদের আস্তানা এবং ব্রিজটিতেও। বখাটেরা মেয়েদের ট্টিজ করে, হুমকি দেয়, প্রেমের প্রস্তাব দেয়, ভয় দেখায়। কোনো কোনো সময় বখাটেরা মেয়েদের রিক্সায় পর্যন্ত ওঠে গায়ে হাত দেয়। ওইসময় ইয়াসমিন (ছদ্ম নাম)-এর পরিবার সন্ত্রাসীদের ভয়ে বিচার চায়নি বলে প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি। বিচার চায় না, এ মর্মে অঙ্গীকারনামাও লিখিয়ে নিয়েছিলেন থানা পুলিশ।
আমরা ওইসময় উপায়ন্তর না পেয়ে চলে এসেছিলাম। এবং বলেছিলাম একদিন ঠিকই পস্তাবে এ এলাকার মানুষ। আজ ভয়ে কোনো অভিযোগ করতে সাহস পেলেন না তারা। পরবর্তীতে এ যৌনসন্ত্রাসীরা এমন ঘটনা ঘটাবে, যা কল্পনারও বাহিরে। ঠিক এমনই একটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটালো এই যৌনসন্ত্রাসীরা। এসিডসন্ত্রাসের শিকার হলো নিস্পাপ তিনটি প্রাণ। জ্বলছে গেলে কঁচি-কোমল তিনটি মুখ। আমাদের স্পষ্ট বক্তব্য হলো, ওই এলাকায় দীঘদিন যাবৎ চলে আসা ইভটিজিং-যৌনসন্ত্রাসী কর্মকা-ের কি খোঁজ খবর রাখেননি ওই এলাকার চেয়ারম্যান? প্রশাসনের ভূমিকা কি ছিলো-চলমান যৌনসন্ত্রাসকে ঘিরে? এভাবে কি সমাজ চলতে পারে? আমরা আর একটিও এমন ভয়াবহ ঘটনা দেখতে চাই না। আমরা চাই, ফারজানা, ফয়সাল ও খাদিজাকে যারা এসিডে দগ্ধ করেছেন, তাদের সুন্দর মুখম-ল যারা বিকৃত করেছেন তাদের যথাযথ বিচার হোক। এমন কঠোর বিচার হোক যাতে করে অন্য কোনো যৌনসন্ত্রাসী-এসিডসন্ত্রাসী ভুলেও সাহস না করে এ লজ্জা ও বিভৎস পথে এগুনোর।

লেখক, আহ্বায়ক
দাউদকান্দি উপজেলা ইভটিজিং প্রতিরোধ কমিটি
দাউদকান্দি, কুমিল্লা

Check Also

করোনাযুদ্ধে প্রথম জীবন উৎসর্গকারী কনস্টেবল জসিমকে বুড়িচংয়ে সমাহিত

বুড়িচং প্রতিনিধিঃ করোনাযুদ্ধে পুলিশে প্রথম জীবন উৎসর্গকারী কনস্টেবল জসিম উদ্দিনকে (৩৯) কুমিল্লায় সমাহিত করা হয়েছে। ...

Leave a Reply