আ’লীগ নেতা খুনের ঘটনায় উত্তাল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল মহাসড়ক অবরোধ : বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ

ব্রাহ্মণবাড়িয়া / ২২ অক্টোবর (কুমিল্লাওয়েব ডটকম)———-
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে আওয়ামী লীগ নেতা ইকবাল আজাদ খুনের ঘটনায় গতকাল সোমবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত উপজেলা সদরের সর্বত্র উত্তপ্ত পরিবেশ বিরাজ করে। এ খুনের ঘটনার সাথে জড়িত থাকার সন্দেহে বেশকয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার বাড়ি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে একদল বিক্ষুব্ধরা হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাংচুর করে। এসময় তারা কয়েকটি বসতঘর ও একটি পোল্টি ফার্মে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে বিক্ষুব্ধরা ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে। এসব ঘটনায় গতকাল গোটা সরাইলে জনমনে আতংক ছিল। অপ্রীতিকর ঘটনার আশংকায় সদরের বিভিন্ন দোকানপাট সকাল থেকেই বন্ধ রাখে ব্যবসায়ীরা। উপজেলা সদরে সাধারণ মানুষের উপস্থিতি ছিল কম। এছাড়া এ খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে রবিবার রাতে সরাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজী আবদুল হালিমের ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের বাসায় হামলা ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। সরাইল উপজেলা সদরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি সদস্যরা টহল দিচ্ছে ।
এদিকে নিহত ইকবাল আজাদের লাশের ময়না তদন্ত গতকাল সোমবার সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতাল মর্গে হয়। পরে বাদ জোহর জেলা সদরের টেংকের পাড় ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় নামাজে জানাজা। এতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের সংসদ সদস্য র. আ. ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, জেলা প্রশাসক নূর মোহাম্মদ মজুমদার, পুলিশ সুপার জামিল আহমদ, পৌর মেয়র মোঃ হেলাল উদ্দিন সহ জেলা আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ ও বিভিন্ন স্তরের মানুষ অংশ নেয়। জানাজার পর নিহতের লাশ ঢাকায় বারডেম হাসপাতালে হিমাগারে রাখার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পারিবারিক সূত্র জানায়, কানাডা প্রবাসী নিহতের পুত্র আসার পর তার লাশ গ্রামের বাড়ি সরাইলের কুট্টাপাড়ায় দাফন করা হবে।
এদিকে এই আ’লীগ নেতার খুনের ঘটনার জের ধরে সোমবার ভোর থেকেই সরাইল সদর, কুট্টাপাড়া ও সৈয়দটুলা এলাকায় থমথমে অবস্থা শুরু হয়। সকাল থেকেই বিক্ষুব্ধ জনতা মিছিল নিয়ে একে একে প্রতিপক্ষের বেশ কয়েকটি বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। বিক্ষুব্ধ জনতা কুট্টাপাড়ায় উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী রফিক উদ্দিন ঠাকুরের বাড়িতে ভাংচুর চালায় এবং তার একটি মুরগী খামার আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে বিক্ষুব্ধরা। পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে সরাইল সদর ইউনিয়ন আ’লীগের সভাপতি ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার ইসমত আলীর বাড়ির বেশক’টি বতসঘর। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও যুবলীগের আহবায়ক মাহফুজ আলীর বাসায় ভাংচুর হয়েছে। পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে এ ঘটনায় অভিযুক্ত সোহেলের চাচা সাবেক চেয়ারম্যান ইদ্রিস আলীর ১টি বিল্ডিং ঘর, ১টি টিনের ঘর, ইউনুস আলীর ৩টি টিনের ঘর, সিদ্দিক আলীর ২টি টিনের ঘর, ইউসুফ আলীর ১টি টিনের ঘর। বিক্ষুব্ধরা সরাইল সদরে ঢুকে উপজেলা সিপিবির সভাপতি রফিকুর রহমানের ১টি টিনের দোকান, ঘাতক সোহেলর ছোট ভাই বাবুর কাপড়ের দোকান, ছোট দেওয়ান পাড়ায় ঠাকুর বাড়ির সামনে লিমনের দোকানে হামলা করে ভাংচুর করে। ভাংচুরের শিকার হয়েছে উপজেলা ছাত্র সমাজের সাধারণ সম্পাদক মজিদ বক্সের সেভেন ফ্যাশন নামক কাপড়ের দোকান। সদরের বড্ডাপাড়ায় অবস্থিত উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও সদর ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল জব্বারের দোতলা বাড়িতেও চড়াও হয় বিক্ষুব্ধরা। এ সময় তারা ঘরের ভেতর মালামাল তছনছ করে। বিক্ষুব্ধ জনতা সকাল ১০টার দিকে লাঠিসোটা নিয়ে ঢাকা সিলেট মহাসড়কে অবরোধ সৃষ্টি করে। রাস্তার উপর টায়ার পুড়িয়ে এবং বিক্ষোভ মিছিল করে মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। শত শত বিক্ষুব্ধ জনতা মহাসড়কে কয়েক দফায় অবরোধ করে দুপুর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩ ঘন্টা ঢাকা সিলেট সহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ রাখে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফয়সল মাহমুদ বিক্ষুব্ধ নেতা কর্মীদের আশ্বস্ত করলে দুপুরের পর থেকে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
এদিকে গতকাল গোটা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ইকবাল আজাদের খুন হওয়ার ঘটনা ছিল লোকের মুখে মুখে। ইকবাল আজাদকে পূর্ব ঘোষণা দিয়ে হত্যা করা হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শী ও রাজনীতিবিদদেও সঙ্গে আলোচনা করে জানা গেছে। আওয়ামীলীগ দলীয় কোন্দলের জের ধরেই তার উপর এ হামলা হয় বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। এদিকে সরাইলে অপ্রীতিকর ঘটনার আশংকা করেছিলেন ইকবাল আজাদ নিজেই। তাকে হত্যা করার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছিল আওয়ামীলীগ নেতা মাহফুজ আলীর সহ তার অনুসারীরা। গত রোববার তারা দিনের বেলা প্রকাশ্য মহড়াও দেয়। ইকবাল আজাদ বিষয়টি নিয়ে রোববার ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসেছিলেন। পৌর মেয়র জেলা আওয়ামীলীগের সহ সভাপতি মোঃ হেলাল উদ্দিন ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মেজর অবঃ জহিরুল হক খান বীর প্রতীক জানান, সরাইলে উদ্বূদ পরিস্থিতি নিরসনে ইকবাল আজাদ আমাদের শরনাপন্ন হয়েছিলেন রোববার । তার সাথে শেষ দেখা পর্যন্ত এ বিষয় নিয়েই আমরা আলোচনা করেছি। সন্ধ্যায় বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য আমরা উদ্যোগও নিয়েছিলাম । আর এ সন্ধ্যায়ই নির্মম ভাবে খুন হয়েছে আমাদের জনপ্রিয় এই নেতা। তারা ঘটনার নিন্দা জানান এবং সে যেই হোক তাদের দৃস্টান্ত মূলক শাস্তির দাবী জানান।
এদিকে হত্যাকান্ড প্রসঙ্গে সরাইল ছোট দেওয়ান পাড়ার রিক্সাচালক মো. আলী বলেন, অনেক মানুষের সামনে প্রকাশ্যে ইকবাল আজাদকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। তাকে পেলেই বল্লম বিদ্ধ করার ঘোষণা দেয় তারা।
হত্যাকান্ডের প্রত্যক্ষদর্শী দোকানী হোসেন মিয়া বলেন, একদল যুবক প্রথমে অটোরিক্সা দিয়ে প্রাইভেটকারের গতিরোধ করে। তিনি নামার মুহুর্তেই এলোপাথারি হামলা চালানো হয়।
এদিকে গত ১২ অক্টোবর থেকে নিজ দলের নেতা কর্মীদের হাতে সরাইল উপজেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি হাজী আবদুল হালিম লাঞ্ছিত হওয়ার পর থেকে প্রায় ১ সপ্তাহ যাবৎ সরাইলে বিরাজমান উত্তপ্ত পরিস্থিতি, প্রকাশ্যে ইকবাল আজাদকে হত্যার ঘোষণা হলেও স্থানীয় পুলিশ বিষয়টি তেমন আমলে নেয়নি বলে অভিযোগ করেছে অনেকে। ঘটনার দিন সরাইল থানা সংলগ্ন এলাকায় প্রকাশ্যে রাম দা, বল্লম নিয়ে মহড়া হলেও পুলিশ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়নি। এদিকে এ হত্যাকান্ডের পর সরাইলে অনেক নেতা গা ঢাকা দিয়েছে। মোবাইলেও অনেককে পাওয়া যায়নি। এমনকি সরাইলের মহাজোটের সংসদ সদস্য এডঃ জিয়াউল হক মৃধাও এখন নীরব। গতকাল নিহত নেতার নামাজের জানাজায়ও তাকে দেখা যায়নি। এ নিয়েও মানুষের মাঝে নানা কথা উঠছে।
এ ব্যাপারে সরাইল উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক অ্যাডভোকেট আশরাফ উদ্দিন মন্তু বলেন, এটি পরিকল্পিত খুন। দলীয় সভাপতি আব্দুল হালিম, সাধারণ সম্পাদক রফিক উদ্দিন ঠাকুরের নির্দেশে মাহফুজ আলী, তার শ্বশুর ও শ্যালকরা ইকবাল আজাদকে খুন করেছে। তিনি বলেন, এ ঘটনায় উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি-সাধারন সম্পাদক সহ ২২জনের বিরুদ্ধে নিহত ইকবাল আজাদের ভাই ইঞ্জিনিয়ার জাহাঙ্গীর বাদি হয়ে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এদিকে অপর গ্রুপের নেতা, উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান রফিক উদ্দিন ঠাকুরের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি হত্যাকান্ডের সাথে তার সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করে বলেন, ইকবাল আজাদ সরাইলের জনপ্রিয় নেতা। তার মৃত্যুতে আমি শোকাহত। আমি দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করি।
সরাইল থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. গিয়াস উদ্দিন বলেন, পূর্ব থেকে ঘোষণা দিয়ে হত্যার বিষয়টি ঠিক নয়। সোমবার বেশ কিছু ঘটনা ঘটে গেছে। তবে এখন পরিস্থিতি শান্ত আছে।
র‌্যাব-৯ ভৈরব ক্যাম্পের অধিনায়ক মেজর আবদুল¬াহ আল মামুন বলেন, কিছু লোক সড়ক অবরোধের চেষ্টা করেছে। এছাড়া বেশ কয়েক স্থানে লুটপাট, অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। আমার পক্ষ থেকে সার্বিক দিক লক্ষ্য রাখা হচ্ছে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত রাত ৮ টায় সরাইল সদরে কয়েক হাজার লোক বিক্ষোভ মিছিল করছিল ।
সরাইল প্রসঙ্গে পুলিশ সুপার জামিল আহমদ জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছি। বিভিন্ন স্থানে পুলিশ মোতায়ন আছে। এ ঘটনায় জড়িত ১ জনকে হত্যাকান্ডে ব্যহার করা বল্লম সহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকীদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চলছে। তিনি সকলকে ধৈর্য ধরার আহবান জানান ।

(আরিফুল ইসলাম সুমন, স্টাফ রিপোর্টার ব্রাহ্মণবাড়িয়া)

Check Also

করোনাযুদ্ধে প্রথম জীবন উৎসর্গকারী কনস্টেবল জসিমকে বুড়িচংয়ে সমাহিত

বুড়িচং প্রতিনিধিঃ করোনাযুদ্ধে পুলিশে প্রথম জীবন উৎসর্গকারী কনস্টেবল জসিম উদ্দিনকে (৩৯) কুমিল্লায় সমাহিত করা হয়েছে। ...

Leave a Reply