সরাইলে খাস পুকুরের ইজারায় ফায়দা লুটেছে ক্ষমতাসীনরা টিঘর গ্রামে উত্তেজনা, গ্রেফতার আতঙ্কে ৪ হাজার মানুষ

ব্রাহ্মণবাড়িয়া / সেপ্টেম্বর ২১ (কুমিল্লাওয়েব ডটকম)—–
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে টিঘর খাস পুকুরের ইজারা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে গ্রামের দু’দলের মধ্যে টান টান উত্তেজনা চলছে। মাইকে ঘোষণা দিয়ে দু’দল বুধবার সকালে সংঘর্ষের প্রস্তুতি নিলে মঙ্গলবার গভীররাতে পুলিশ অভিযান চালিয়ে দাঙ্গার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৮ ব্যক্তিকে আটকের পর আদালতের মাধ্যমে তাদের জেলহাজতে প্রেরণ করে। এছাড়া এ পুকুর সংক্রান্ত অন্য মামলায় গ্রামের কয়েকজন জেলহাজতবাস করছেন বলে গ্রামবাসী জানিয়েছেন। এসব ঘটনায় উপজেলার টিঘর গ্রামের অন্তত ৪ হাজার মানুষ গ্রেফতার আতঙ্কে গত চার দিন ধরে গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র রাত্রিযাপন করছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ খাস পুকুর নিয়ে দু’দলের বিরোধকে কেন্দ্র করে পক্ষে-বিপক্ষে প্রায় অর্ধডজন মামলা ও একাধিক সংঘর্ষসহ গ্রামে নানা ঘটনা ঘটেছে।
জানা গেছে, উপজেলার পানিশ্বর ইউনিয়নের টিঘর মৌজায় ১৭৪৮ দাগে প্রায় ১৮ একর পরিমাণ সরকারী খাস পুকুর ইজারা পেতে গ্রামের এমদাদুল হক ইউনুছ মিয়ার ‘টিঘর বড়দিঘি মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি’ এবং একই গ্রামের হাবিবুর রহমানের ‘সোনার বাংলা মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি’ নামে দু’টি সমিতি স্থানীয় প্রশাসনের কাছে আবেদন করে। ইজারা নিয়ে শুরু হয় লবিং-গ্র“পিং। উপজেলার শীর্ষ জনপ্রতিনিধিসহ ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে সমিতি দু’টির পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নেন। এতে বিপাকে পড়ে যান প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা। একপর্যায়ে তৎকালীন উপজেলা জলমহাল কমিটির সভাপতি ও নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. হেলাল উদ্দিন টিঘর বড়দিঘি মৎস্যজীবি সমিতিকে তিন বছরের জন্য এ পুকুর ইজারা দিয়ে দেন। এতে পরিস্থিতি ভয়াবহ ধারণ করে। ইজারা বঞ্চিতরা দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নির্বাহী কর্মকর্তাকে তার দফতরে অবরুদ্ধ করে রাখে। খবর পেয়ে পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি সামাল দেয়। জনপ্রতিনিধিসহ রাজনৈতিক নেতারা বিষয়টি সমাধান করতে দুই সমিতির লোকেরা মিলেমিশে এ পুকুর চাষ করার সিদ্ধান্ত দিয়ে নন-জুডিশিয়াল ষ্ট্যাম্পে একটি চুক্তিনামা করে দেন। পরে ইজারাদাররা লাখ টাকার পোনামাছ এ পুকুরে মাছ চাষ করলেও পুকুর নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের সিদ্ধান্তে আপত্তি তুলেন ইজারাপ্রাপ্ত সমিতির অনেক সদস্য। এতে পুকুর নিয়ে দু’দলের মধ্যে আবারো নতুন করে বিরোধ সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে।
টিঘর গ্রামের ইউপি সদস্য মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, এ খাস পুকুর নিয়ে গ্রামে দু’দলের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছে। দু’দলের বিরোধে একাধিক মামলা-মোকদ্দমাসহ গ্রামে সংঘর্ষ হয়েছে। এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গ্রামের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষেরা। পুলিশের গণগ্রেফতারে ১৮ ব্যক্তি আটকের পর থেকে গ্রামের প্রায় ৪ হাজার মানুষ বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে রাত্রিযাপন করছে।
পানিশ্বর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. নূরুল হক বলেন, এ খাস পুকুর নিয়ে অনেকের মাঝে লোভ সৃষ্টি হয়েছে। শীর্ষ জনপ্রতিনিধিসহ রাজনৈতিক নেতারা এ পুকুর ইজারা নিয়ে বাণিজ্য করেছে। তাদের এ পক্ষ-পাতিত্বের জন্যই টিঘর গ্রামে অস্থিরতা বিরাজ করছে। পুলিশি গ্রেফতারের ভয়ে গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে থাকছে।
এমদাদুল হক ইউনুছ মিয়া বলেন, সরকারের জলমহাল নীতিমালা অনুযায়ী আমাদের সমিতি এ পুকুর ইজারা পেয়েছে। কিন্তু ইজারা বঞ্চিত প্রভাবশালী লোকদের বাঁধায় গত দুই বছর ধরে আমরা পুকুর থেকে মাছ ধরতে পারছি না। এ পুকুরের মাছ ধরতে আমরা প্রশাসনসহ থানাপুলিশের সহযোগিতা চেয়েছিলাম। কিন্তু প্রভাবশালীদের কারণে এ সহযোগিতাও পাচ্ছি না। তারা রাতের আধাঁরে পুকুরের মাছ চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। টিঘর বড়দিঘি মৎস্যজীবি সমবায় সমিতির একাধিক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই পুকুরের পেছনে এ পর্যন্ত আমাদের প্রায় ৬০ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। এ পুকুর ইজারা পেতে সরকারী রাজস্ব যা দেওয়া হয়েছে, তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি পরিমাণ টাকা দেওয়া হয়েছে উপজেলার শীর্ষ এক জনপ্রতিনিধিসহ কয়েকজন সরকারদলীয় নেতাকে। তারপরও গত দুই বছর ধরে পুকুরের মাছ ধরা যাচ্ছে না। এ ঘটনায় থানায় মামলাও করা হয়েছে। থানাপুলিশের পেছনে খরচ করা হয়েছে হাজার হাজার টাকা। তবুও এ সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।
এদিকে এ খাস পুকুরের ঘটনায় হাবিবুর রহমান জেলে থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে তার স্ত্রী বিলকিস বেগম বলেন, টিঘর মৌজায় ১৭৪৭ দাগে তাদের একটি পুকুর পাড় ভেঙ্গে ১৭৪৮ দাগের সরকারী পুকুরের সঙ্গে একটি পুকুরে পরিণত হয়েছে। এই পুকুরের পাড়ের লোকজন মৎস্যজীবি সমিতির মাধ্যমে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পুকুরটি ইজারা পাওয়ার দাবী করেছিল। অজানা কারণে প্রশাসন দেয়নি। পরে এ নিয়ে মামলা হয়। বর্তমানে উচ্চ আদালতে মামলা চলমান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টিঘর গ্রামের সোনার বাংলা মৎস্যজীবি সমবায় সমিতির কয়েকজন সদস্য বলেন, নেতাদের কথামতো লাখ টাকা দিয়েছি। তবুও পুকুর ইজারা পাইনি। শীর্ষ এক জনপ্রতিনিধিকে আলাদাভাবে টাকা দেওয়া হয়েছে। তিনি শুধু আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন।

Check Also

করোনাযুদ্ধে প্রথম জীবন উৎসর্গকারী কনস্টেবল জসিমকে বুড়িচংয়ে সমাহিত

বুড়িচং প্রতিনিধিঃ করোনাযুদ্ধে পুলিশে প্রথম জীবন উৎসর্গকারী কনস্টেবল জসিম উদ্দিনকে (৩৯) কুমিল্লায় সমাহিত করা হয়েছে। ...

Leave a Reply