মো. আলী আশরাফ খান :
একটি জাতির মূল চালিকাশক্তি নিঃসন্দেহে তরুণ সমাজ। তরুণরাই দেশ-জাতিকে ক্রমে ক্রমে উন্নতির দিকে টেনে নেওয়ার বরিাট ভূমিকা রাখে-রেখে আসছে যুগে যুগে। সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে তুলনা করলে আমাদের তরুণরা কোনো অংশেই মেধা, মনন ও উন্নত চিন্তা-চেতনার দিক দিয়ে কম নয়। এককথায় নিজ দেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার দিকে তাকালে দেখা যায়, আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা ভালো অবস্থান দখল করে আছে; তথ্যপ্রযুক্তিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও নতুন নতুন আবিস্কার করে চমকে দিচ্ছে বিশ্বকে। আর আমাদের এসব অগ্রগতি-গৌরবকে ধ্বংস করার লক্ষে কতিপয় দেশ পিছে লেগে আছে দীর্ঘদিন ধরে। এসব দেশ বিভিন্ন অপকৌশলে আমাদের তরুণ সমাজের ভেতর ঠুকিয়ে দিচ্ছে এমন কিছু মারাত্মক ক্ষতিকর অপসংস্কৃতি যা আমাদের সন্তানদের মেধাকে ধ্বংস করে বিপথগামী করার পাশাপাশি ধ্বংসের ধারপ্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছে। এর মধ্যে নামে বেনামে মাদককেই প্রথম সারির একটি বলতে হবে।
আজ অপ্রিয় সত্যকথা, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে দীর্ঘদিন ধরে ফেনসিডিল নামক যে ওষধটি এ দেশে সুকৌশলে পাঠানো হচ্ছে, আসলে এটি এমন একটি মাদক, যা তরুণ সমাজকে সর্বনাশ করে ফেলছে। তাদের মেধা ও চিন্তাশক্তিকে স্তিমিত করে নরকের পথে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া গাঁজা, হেরোইন, আফিম, ভায়াগ্রা, ইয়াবা, আইসপিল এর সঙ্গে এখন আরো নিত্যনতুন মাদকদ্রব্য যোগ হচ্ছে-সিসা, ড্যান্ডি, কিটামিন, পেট্টোল, নেইলপলিশ, পিচের ধোঁয়া, ইফিড্রিন, এলএসডি, নাইজেলাসহ বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল। এসব নেশার উপকরণ হিসেবে তরুণদের ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন কৌশলে তাদেরই লোক দ্বারা। বিপদজনক বিপদজনক এসব দ্রব্যে আসক্ত করে তোলা হচ্ছে আমাদের কোমলমতি ছেলেমেয়েদের। যার পরিণাম ভয়াবহ। প্রথমে কিছু সহজ-সরলদের মধ্যে এমনভাবে এসব উপকরণ ঠুকানো হয়, যা বোঝাই মুশকিল। তারা একটির সঙ্গে আরেকটি মিশিয়ে নতুন স্বাদের লোভ দেখিয়ে মাতাল করে তুলছে তরুণদের। আমরা লক্ষ করবো যে, সম্প্রতি সিসা নামের নেশার প্রতি তরুণরা বেশ ঝুঁকছে। উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীরা সবচে’ বেশি পছন্দ করছে সিসাকে। যদিও সিসাকে দেশের প্রচলিত আইনে মাদক হিসেবে গণ্য করা হয়না। কিন্ত এটি শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি সাধনের ক্ষেত্রে একটি মারাত্মক ভয়াবহ দ্রব্য। অভিভাবকরা এখন তাদের সন্তানদের নিয়ে সিসার ব্যাপারে বেশ শংকিত।
অথচ, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর বলছে, মাদক আইনে সিসা অর্ন্তভুক্ত না হওয়ায় এর বিরুদ্ধে তাদের করণীয় কিছু নেই। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে সিসার উপাদানের সঙ্গে বিভিন্ন মাদক মিশিয়ে ব্যবহার করছে মাদকাসক্তরা; এ সিসাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে সন্ত্রাসী কর্মকা-, বুঁদ হয়ে নানা অপরাধ করে বেড়াচ্ছে সিসা-মাদকসেবীরা। মাদকনিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে মাদক আইনে মোট ২৩ টি কেমিক্যাল মাদক হিসেবে চিহ্নিত। কিন্তু এখন এমন অনেক কিছু রয়েছে যা মাদক হিসেবে গ্রহণ করতে শিখছে আমাদের ছেলেমেয়েরা। যা সরকারের তালিকাভূক্ত মাদকের চেয়েও ভয়ঙ্কর। ওইসব মাদক তালিকাভুক্ত না হওয়ায় তাদের করার কিছু নেই, এটি বলে পার পেতে চাইছে তারা। যদিও এসব কেমিক্যাল একাধিক ওষুধ কোম্পানি ওষুধ তৈরির জন্য আমদানি করে। কিন্তু কিছু অতি মুনাফালোভী তা খোলা বাজারে বিক্রি করে তরুণদের ভবিষ্যতকে ধ্বংস করছে। এছাড়া চোরাই পথেও প্রচুর কেমিক্যাল ঢোকে কিছু দুষ্টু প্রসাশনের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে।
ভয়ংকর ব্যাপার বর্তমানে দেশে শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী ও বয়স্ক লোকজন ৩২ ধরনের মাদক সেবন করে। ভিন্ন ভিন্ন নামে এসব মাদক বাজার দখল করে আছে। হিরোইন, গাঁজা, মরফিন, ইয়াবা, ফেনসিডিল, আইসপিল, ভায়াগ্রা, চোলাই মদ, দেশি মদ, বিদেশি মদ, বিয়ার, রেক্টিফাইড স্পিরিট, কেডিন, তাড়ি, প্যাথেডিন, বুপ্রেনরফিন, টিডি জেসিক, ভাং, কোডিন ট্যাবলেট, ফার্মেন্টেড, ওয়াশ (জাওয়া), বনোজেসিক ইনজেকশন (বুপ্রেনরফিন), টেরাহাইড্রোবানাবিল, এক্সএলমুগের, সানাগ্রা, টলুইন, পটাশিয়াম পার ম্যাগানেট, মিথাইল, ইথানল ও কিটোন। এছাড়া ইনোকটিন, সিডাক্সিন, ব্যাথানাশক ওষুধ জামবাক, টিকটিকির লেজ পুড়িয়ে নেশাদ্রব্য হিসেবে গ্রহণ করতে দেখা যায় অনেককে। এসব নেশাদ্রব্যকে ঘিরে নিন্মবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্তদের মধ্যে গড়ে ওঠেছে বিরাট ব্যবসা-বাণিজ্য। যে কারণে এভাবে একের পর এক নেশার উপকরণ সহজলভ্য হওয়ার ফলে এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অনৈতিকতার দরুণ তরুণ সমাজের যেমন বারোটা বাজছে তেমনি দেশেরও বাজছে বারোটা।
আমি যে এলাকায় বাস করি, এখানে মাদক পাওয়া একেবারেই সহজ। মূল্য একটু বেশি হলেও চাহিবামাত্র ঘরের দরজা কিংবা রাস্তার কোনো মোড়ে যে কোনো মাদক পৌঁছে দেবে বিক্রেতারা। বড় ধরনের একটি সিন্ডিকেট রয়েছে এখানে। এখানকার প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও নাকি মাদক সেবন ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত-এমন অভিযোগ এলাকাবাসীর। জনৈক লেখক এ বিষয়ে একটি কলাম লিখেছিলেন বেশ কিছুদিন পূর্বে। লেখাটি প্রকাশের পর থানার ওসি এক সাপ্তাহিক পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদককে প্রশ্ন করেছিলেন, এই কলামিস্টের বাড়ি কোথায়রে ? কি করে সে? এত্ত বড় সাহস তার! প্রশাসনের বিরুদ্ধে এভাবে লেখালেখি করে!! সম্পাদক সাহেব বরাবরই বলেছিলেন, দেখুন, যারা কলাম লেখে, সমাজের মঙ্গলের জন্যই লেখে। এখানে ব্যক্তি স্বার্থ নয় জাতরি স্বার্থই নিহিত থাকে। সুতরাং ওনি যা লিখেছেন, ভালই লিখেছেন। এটাতে সমাজের মঙ্গলই হবে। আর আমার মনে হয়, পূর্বেকার যেকোনো লেখার তুলনায় তার এবারের মাদক সংক্রান্ত লেখাটি অনেকটা লগু’।
এখন আমাদের প্রশ্ন, আসলেই কি দাউদকান্দি তথা গৌরীপুরের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা মাদক লেনদেনের ক্ষেত্রে পরিশুদ্ধ? যদি তাই না হয়ে থাকে, তাহলে পরিশুদ্ধ হওয়ার জন্য তৈরি হওয়ার দরকার নয় কি? আমরা তো প্রায়ই দেখি, পুলিশের পক্ষ থেকে জোরালো বক্তব্য আসে, যেভাবে হোক জাতির ঘাড় থেকে মাদক-সর্বনাশের খড়গ সরাতেই হবে। এবং সেই ঘোষণা মতে দস্তুরমত যুদ্ধও শুরু করে তারা। ঢাকঢোল পিটিয়ে, মাইকিং করে কখনই মাদক বিক্রেতা-মাদকসেবনকারী কিংবা আশ্রয়-প্রশ্রয় ও লালন-পালনকারীদের সায়েস্থা করা বা মাদক নির্মূল সম্ভব হয় না, হবে না। এটা তাদের বুঝতে হবে। হয়তো স্বল্পসংখ্যক মাদকাপরাধী আটক করতে পারবেন পুলিশ। কিন্তু তা লোক দেখানোই বলতে হবে। কারণ যেখানে দেশের প্রশাসনের বিরুদ্ধে মাদক সম্পর্কে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। এ জঘন্য ব্যবসা এবং মাদকসেবনে প্রশাসনের প্রায়সব কর্মকর্তা, বড় বড় এম.পি-মন্ত্রী, আমলাসহ ছোট্ট ছোট্ট টোকাইরা পর্যন্ত জড়িত সেখানে মিছেমিছে মাদক নির্মূলের নামে মহড়া কিংবা অভিযান লোক দেখানো নয় কি? আমরা মনে করি, মাদক থেকে দেশ-জাতিকে বাঁচাতে হলে সর্বাগ্রে প্রশাসনকে ভেজালমুক্ত হতে হবে। সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনানুযায়ী বিভিন্ন কৌশল অবলম্বনের মধ্যদিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। জাতির স্বার্থেই অন্যদের ঢুকিয়ে দেয়া মাদক দ্রব্যের ব্যাপারে সর্তক হতে হবে।
আমরা দাউদকান্দি, তিতাস, মেঘনা, হোমনা, চান্দিনাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে এমন অনেক খবর পাই, যেখানে পুলিশের সহযোগিতায় মাদক বিক্রি ও সেবনকারীদের সহযোগিতা করা হয়। এমনও অভিযোগ রয়েছে, ভ্রাম্যমাণ হাইওয়ে পুলিশ এবং থানা পুলিশ মাদকের বহু চালান আটক করে নামমাত্র জমা দেন উপরে। বিভিন্ন মাদক বিক্রির স্পটে হানা দিয়ে অনেক মাদকাসক্ত ধরে টাকার লেনদেনে ছেড়ে দেন। কিন্তু তারা একবার ভেবে দেখেছেন কি, যদি তাদের প্রিয় সন্তানটি মাদকাসক্ত হয়ে একসময় মৃত্যুমুখে পতিত হয়, তখন কি অবস্থা হবে তাদের? নিজেদের দিয়েই তুলনা করতে হবে এসবের। ভাবতে হবে সমাজের অন্যসব কিশোর-তরুণসহ সবশ্রেণীর মানুষের কথা। সমাজের অন্যরা ধ্বংস হওয়া মানে নিজেরা ধ্বংস হওয়া-এটা বুঝতে হবে। একজন মানুষ হিসেবে-কর্মকর্তা হিসেবে সঠিক দায়িত্বটি পালন করলে যেমন শত-শত, হাজার-হাজার কচি-কোমলমুখ মাদকের নীলবিষ থেকে বাঁচবে, তেমনি অনেক বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানসহ অনেক পরিবার সুখে-শান্তিতে দিনযাপন করতে পারবে। আমাদের বিশ্বাস, প্রশাসন পারে না এমন কোনো কাজ নেই। প্রশাসন বিবেকবান, কঠোর ও কঠিন হলে অবশ্যই সমাজ থেকে মাদক নামের অভিশাপকে দূর করা সম্ভব।
-লেখক: কবি, কলামিস্ট, প্রবন্ধকার ও সংগঠক, গৌরীপুর, দাউদকান্দি, কুমিল্লা।