মো. আলী আশরাফ খান :
আমাদের বুঝতে হবে,বছর বছর ঘটা করে অনুষ্ঠানাদি পালন করেই বিশ্ব পরিবেশ সংশিষ্ট বিষয়সমূহ ধ্বংসের মুখ থেকে বাঁচানো সম্ভব হবে না-যতক্ষণ বিশ্বব্যাপি কার্যকরী কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করে হবে। আমরা দেখি, হরেক প্রতিপাদ্য নিয়ে বছরের পর বছর বিভিন্ন দিবস পালন করা হয়, রাকঢাক করে সম্মেলনের আয়োজনও কম হয় না। কিন্তু কাজের কাজ তেমন একটা হতে দেখা যায় না। বিশেষ কিছু অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে গা ছাড়া গোছের দায়সারাভাব নিয়ে পথ চলা; বড় বড় বক্তব্যের মধ্যদিয়ে বাহ্বা-হাততালি পাওয়া এবং দেশ-বিদেশে প্রশংসা কুড়ানোয় কোনো স্বার্থকতা যে নেই-এটি আগে বুঝতে হবে। বরং এসবে যে সময় ও অর্থ নষ্ট হয়-এটিকেই গুরুত্ব দেওয়া দরকার সর্বাগ্রে।
যদি আমরা এককথায় পরিবেশ রক্ষায় কার্যকরী কোনো ভূমিকা না-ই নিতে পারি, তবে কেনো এসব লোক দেখানো র্যালি-মানববন্ধন, সভা-সেমিনার, লিফলেট-পোস্টার বিতরণ এবং ইত্যাদি ইত্যাদি অনুষ্ঠান চালানো? আগেকার যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি বেশি এশিয়ার দেশগুলোতে জোরেশোরে বিশ্ব পরিবেশ রক্ষার নামে নানা কর্মসূচী পালিত হয়। কিন্তু কাজের কাজ তেম কিছুই হয় না। আমরা কি ভাবে দেখেছি, এ বছর বছর প্রতিপাদ্যকে পরিবর্তন, বিরাট করে সম্মেলন ও কর্মসূচীকে কাগুজে সীমাবদ্ধ কিংবা মুখের শোাগানে আবদ্ধ থেকে পরিবেশ রক্ষা করতে পারবো? নাকি কাজের কাজকে গুরুত্ব দিয়ে দেশ-বিশ্ব কর্ণধারদের জোরালো কার্যক্রম শুরু করতে হবে? নিশ্চয়ই আমরা অকপটে স্বীকার করবো যে, পরিবেশ-জলবায়ূ-আবহাওয়া এ তিনটিই একটি-পরিবেশ-যা বাঁচলে ঠিক থাকলে আমরা বাঁচবো, বাঁচবে দেশ, বাঁচবে বিশ্ব। যদি তাই হয়, বিশ্বব্যাপি পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনটি কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে আমাদের বাস্তব ভেতরগত কর্মকাণ্ডের নমুনা দেখে।
আমরা হয়তো অনেকেই জানি, বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকাও এখন অনেকটা গুরুত্বের সঙ্গে পরিবেশের কথা বলছে; ঢাকঢোল পিটিয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রমাণ করার চেষ্টায়ও মশগুল তারা। অথচ, পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্টে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে প্রথমে ইউরোপ-আমেরিকার মত শিল্পোন্নত দেশগুলোই দায়ি। এসব দেশসমূহ বিশ্বব্যাপি আদিপত্য বিস্তার করতে যতরকম গলাবাজি করুক না কেনো, প্রকৃত পরিবশেবাদীরা কিন্তু এখন যথেষ্ট সচেতন, সাধারণ মানুষও বোঝে এখন তাদের কারসাজি। অপ্রিয় হলেও সত্য, তাদের চোখে পড়ে না-বিশ্বের প্রায় সর্বত্র ঘটে যাওয়া প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, ভূকম্পন, সুনামি, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, অতি গরম-অতি ঠান্ডাসহ নানান ভয়াবহ দূর্যোগ যে, এখন নিত্যকার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে! এক থেকে দেড় ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বিশ্বে প্রাকৃতিক দূর্যোগ প্রায় তিনগুণ বেড়ে গেছে। ফলে দ্রুত বদলে যাচ্ছে পৃথিবী-বসবাসের অনুপযোগী হচ্ছে পরিবেশ। বদলাচ্ছে প্রকৃতির রূপ-রং-রস। সেই কঠিন সময়টি হয়তো আর বেশি দূরে নয়, যখন বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে তলিয়ে যাবে; বিরাণ হয়ে যাবে আমাদের এ পৃথিবীর অনেক বাসযোগ্য এলাকা। বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০৫০ সাল নাগাদ এশিয়ায় কৃষি উৎপাদন ৩৫/৪০ ভাগ কমে যাবে; আর কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়ার অর্থ হলো-এ অঞ্চলের অধিবাসীদের জীবনমানে চরম বিপর্যয় নেমে আসা; মানুষ পথে-ঘাটে না খেযে মরার মতো অবস্থা হওয়া। এরচেয়েও বড়কথা, বিশ্ব পরিবেশের ভারসাম্য যেভাবে দ্রুত বিনষ্ট হচ্ছে, তাতে করে ভয়াল প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা বিপর্যয় আমাদেরকে গ্রাস করবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এ বিপর্যয়ে এশিয়ার নিন্মাঞ্চল দেশগুলোর মধ্যে বিশেষ করে বাংলাদেশের ক্ষতির পরিমাণ যে কতটা হবে তা বলা মুসকিল। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের ধারণা, উষ্ণায়নের প্রভাবে সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির দরূণ আগামী ৪০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা চিরতরে লোনা পানির নিচে চলে যাবে। মোটকথা, শুধু বাংলাদেশই নয় বিশ্বের অন্যান্য দেশও মহাদূর্যোগের এক ক্রান্তিলগ্নের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।
এ অতি আসন্ন ভয়াবহতার কথা কথিত পরিবেশবাদীরা কতটা ভাবছে তা কিন্ত তাদের কর্মকাণ্ডের মধ্যে পরিচয় মিলে। আজ যেখানে বিশ্বের সিংহভাগ মানুষ ঐক্যমতে পৌঁছেছে, যেভাবেই হোক বিশ্ব পরিবেশকে বাঁচাতে হবে। অষ্ট্রেলিয়াও তাদের আগেকার ভ্রান্তনীতি পরিবর্তন করে ‘কিয়োটা’ চুক্তিতে সই করেছে। কিন্তু মানবতা নামধারী একটি দেশ বিশ্বের এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি তথা পরিবেশ বিনষ্টে সবচেয়ে বেশি দায়ি হয়েও নিজেদের ধোয়া তুলসিপাতা বলে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে। কোনো সুনিদিষ্ট বক্তব্য ছাড়াই একের পর এক পরিবেশ বিনাশী কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে তারা। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে যে পরিমাণ গ্যাস নিঃসরণে আবহাওয়া ক্রমাগত উষ্ণ হচ্ছে, এর প্রায় ২৫ শতাংশ নিঃসৃত হচ্ছে এ দেশটি থেকে। শিল্পোন্নত বিশ্বের যে পরিমাণ গ্যাস আবহাওয়া মণ্ডলকে দূষিত করে, এর প্রায় অর্ধ্বেক এ দেশের নীতিভ্রষ্টতারই কারণ। বিশ্বের গ্রীণ হাউস-সবুজ বেষ্টনীর গ্যাস নির্গমণের ক্ষেত্রেও এ দেশটিই দায়ি। পরিবেশর ভারসাম্য রক্ষায় যাদের অবদান থাকার কথা সবচেয়ে বেশি, অথচ এরাই গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা বাড়িয়ে দিনে দিনে একের পর এক সমস্যার জন্ম দিচ্ছে। মানব সৃষ্ট এসব কর্মকাণ্ডের জন্য আশঙ্কাজনকভাবে তাপমাত্রার পরিমাণ যে হারে বাড়ছে, এটি নিয়ে স্বল্পন্নোত দেশসহ বিশ্বের প্রায় দেশকর্ণধাররা ভাবলেও গুটি কয়েক ক্ষমতাধর দেশকর্ণধারদের ভাবলেশহীন পথচলাই বলে দিচ্ছে আসলে ওরা কি চায়, ওদের ভবিষ্যৎ চিন্তা-ভাবনাই বা কি।
আজ যেখানে তাপমাত্রার এই বিশ্বব্যাপি ভয়াবহ পরিবর্তন এবং বিশ্বব্যাপি জলবায়ু ও আবহাওয়ার উদ্ভট আচরণ, যেখানে বিশ্বব্যাপি বরফের আচ্ছাদন ১৯৬০ দশক থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে. বিভিন্ন নদী ও হ্রদে বরফ আচ্ছাদনের অবস্থানকাল বড় রকমের পার্থক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে, মেরু অঞ্চলের বাহিরে হিমবাহ ভয়াবহভাবে গলে যাচ্ছে, সমুদ্র উচ্চতা অনেকাংশ বেড়ে মহাবিপর্যয়ের অসনিসংকেত দিচ্ছে বিশ্ববাসীদের, সেখানে তাদের চিন্তা-চেতনায় দিন যত যাচ্ছে ততই নগ্নতার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। নতুন নতুন মারণাস্ত্র তৈরি, জ্বালানী ব্যবহারে মাত্রারিক্ততা; তেজস্ক্রিয়তা, অবাধে বৃক্ষনিধন, পাহাড় কাটা, খাল-বিল, নদী-নালা ভরাট, অবৈধ দখল, গতিপথ পরিবর্তন, মাত্রারিক্ত এয়ারকন্ডিশন-রিফিজেরেটর ব্যাবহার ও ধনিকশ্রেণী কিছু ব্যক্তি-গোষ্ঠী-রাষ্ট্র’র মনগড়া জীবন যাপনকেই দায়ি করতে হয়-এসবের জন্য। আমরা সভা-সেমিনারে বক্তব্য দিই, পরিবেশ রক্ষায় গাছ লাগাতে হবে; একটি গাছ কাটলে তিনটি গাছ লাগান; পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে, যত্রতত্র মিল-ফ্যাক্টরি, ইটভাটা নির্মাণ করা চলবে না; কালোধোঁয়া নির্গত হয় এমন যানবাহন রাস্তায় বের হতে পারবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ, সরকারি গাছ অবাধে কাটা হচ্ছে-চুরি হয়ে যাচ্ছে দেশের বন বিভাগগুলোতে কর্মকর্তাদেরই যোগসাজশে; রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে যাচ্ছে একশ্রেণীর মানুষ। পাহাড় কেটে মাটি বিক্রি, বসতবাড়ি-মার্কেটসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ যেনো সরকারি দল ও অন্যান্য প্রভাবশালীদের পেশায় পরিণত হয়েছে। যেখানে ইচ্ছে সেখানেই তৈরি হচ্ছে মিল-ফ্যাক্টরী, ইটভাটা; আর গাড়ীর কালো ধোঁয়ার কথা বলতে-১০/২০টাকায় পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে আইন নিয়নত্রণকারীরা। এসব দেখার যেনো কেউ নেই এখন, এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে-দায়িত্ব যার, সেই খেয়ে করে সাবাড়!
আমাদের বুঝতে হবে, বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ব্যাপারটিকে যদি আমরা গভীরে গিয়ে না ভাবি, তাহলে আমাদের এই সুন্দর পৃথিবী একদিন সত্যি সত্যিই বদলে যাবে এবং এমন কঠিনভাবে এই প্রকৃতি প্রতিশোধ নেবে আমাদের প্রতি, যা শোধরানো আর কোনোকালেই সম্ভব হবে না। এ অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সর্বপ্রথম ভাবতে হবে দেশ-বিশ্বকর্ণধারদের। কাজ করতে হবে প্রত্যেক জনগোষ্ঠীকে স্ব-স্ব অবস্থান থেকে, পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনা বৃদ্ধির লক্ষ্যে। সময় থাকতে বৃক্ষরোপণ আন্দোলন গড়ে তোলার পাশাপাশি পরিবেশ বিপর্যয় ঘটে এমনসব বিষয়গুলোর ব্যাপারে কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে রাষ্ট্রীয় তথা আন্তর্জাতিকভাবে। তৃণমুল পর্যায়ে অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে বাড়ির আঙ্গিনা, প্রতিষ্ঠানের আঙ্গিনা, রাস্তা-ঘাটের দু’দ্বার-পুকুরপাড় এবং পতিত সব জায়গায় বিভিন্ন প্রজাতীর বৃক্ষরোপণের। পাশাপাশি যত্রতত্র মিল-ফ্যাক্টরী, ইটভাটা নির্মাণ, পলিথিনের ব্যবহার, অবাধে ভরাট ও পয়ঃনিস্কাসনের নাজুক অবস্থা ব্যবস্থা, খাবারদাবারের অবশিষ্ট, গাড়ীর ধোঁয়া, হর্ণ বাজানো যে পরিবেশ বিনষ্টে অনেকাংশে দায়ি, এ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে এসব বিষয়ে কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে বৃহত্তর স্বার্থেই।
পরিশেষে বলবো, বিশ্ববাসী কি আসন্ন এ ভয়াবহ ধ্বংসের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে চায়? উত্তরটি হ্যাঁ হলে, এখনই দেশ-বিশ্ব নেতৃবৃন্দদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে পরিবেশ রক্ষার সুপরিকল্পিত আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
লেখক: কবি, কলামিস্ট, প্রবন্ধকার ও সংগঠক,
গৌরীপুর, দাউদকান্দি, কুমিলা।