পর্যবেক্ষনে কুসিক নির্বাচনঃ প্রত্যাসন্ন ভোটে সন্ত্রাস আর দূর্নীতি কে “না”

দেলোয়ার জাহিদ :

প্রত্যাসন্ন কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন। আশার স্বপ্নজাল বুনে শান্তিপ্রিয় কুমিল্লাবাসী। ৫ই জানুয়ারি আসবে প্রত্যাশিত সেদিন, যেদিনটি হবে “বদলে যাবার আর বদলে দেবার” দিন। যেদিনটি হবে সন্ত্রাস, দূর্নীতি আর চাদাবাজিকে “না” বলার, যেদিনটি হবে সৎ , যোগ্য, শিক্ষিত, মার্জিত, সংস্কৃতিবান, নির্লোভ, নিরহংকারী একজন সেবক নির্বাচন’র। আর নির্বাচিত সে প্রতিনিধিদের হাতে “শান্তি’র নগর কুমিল্লা”কে তুলে দেবার। যেদিনটি হবে ভোটের-মহায়োৎসব, হবেনা আর কেন্দ্র দখল, ভোটের নামে ভোট সন্ত্রাস। নগরীর প্রতিটি কোণে কোণে আম জনতার সংলাপে- জনতাই বেছে নেবে সেইসব মন, সেইসব সজ্জন।

ভোটের আমেজে মেতে উঠেছে কুমিল্লা। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ঘোষিত হয়ছে নির্বাচনের তফসিল,ভোট হবে ৫ই জানুয়ারি, ২রা ডিসেম্বর মনোনয়ন জমার শেষ কার্য্যদিবস, মনোনয়নপত্র বাছাই ৪ ও ৫ ডিসেম্বর এবং প্রার্থীতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ১৪ই ডিসেম্বর। আইনী ও প্রশাসনিক কিছু জটিলতা কাটিয়ে তফসিল ঘোষনার মধ্য দিয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়া পথ চলতে শুরু করেছে।

কুমিল্লায় অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে শতভাগ কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করতে চায় নির্বাচন কমিশন। নারায়ণগঞ্জে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সাফল্য পাওয়ায় বর্তমান এ সিদ্ধান্ত গ্রহনে অবিচল নির্বাচন কমিশন । নগর জুড়ে সঞ্চারিত প্রাণচাঞ্চল্যে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন এর তফসিল ঘোষনা’র সাথে সাথে, অপরদিকে তা প্রত্যাখ্যান করে প্রতিবাদ মিছিল বের করে বিএনপি। এনিয়ে সাধারন মানুষের মধ্যে নির্বাচনকে ঘিরে ব্যাপক উৎসাহ, উদ্দীপনা’র মাঝে ও সৃষ্টি হয়েছে কিছুটা সংশয়। বিএনপি সহ প্রায় সব দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের জনসংযোগ এ নির্বাচনের প্রতি তাদের প্রচন্ড আগ্রহের জ্বলন্ত প্রমান। কুসিক নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারে বিএনপি’র আপত্তি, সে সাথে সেনা মোতায়েনের দাবি তাদের মূলতঃ রাজনৈতিক অবস্থান। প্রধান বিরোধীদল বিএনপি এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে চিঠি দিয়েছে এবং দাবি জানিয়েছে যে তা আমলে না নিলে তাদের নির্বাচন বর্জনের সম্ভাবনা রয়েছে। সিইসি ড. এটিএম শামসুল হুদা কুসিক নির্বাচনে শতভাগ ইভিএম ব্যবহারের – সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন এবং ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশনের প্রত্যয় ও অবস্থানকে আরো স্পষ্ট করেছেন। এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ফেব্রুয়ারিতে। যার ফলে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনই হয়তো হবে এ কমিশনের অধীনে সিটি কর্পোরেশনের শেষ নির্বাচন।

এ নির্বাচন কমিশনের অধীনে রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন হয়েছে। তবে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ভোট হয়নি এখনো যদিও তা মেয়াদ উত্তীর্ন।ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করে নতুন আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়াটি এখন অনেকটা শেষ পর্যায়ে। তাই আগামী ফেব্রুয়ারিতে সরকারের ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) উত্তর ও দক্ষিণের নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা রয়েছে। ডিসিসিকে দুই ভাগ করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে জনমত গড়ে তুলতে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত হলে বিএনপি’র এ বিষয়ে রাজনৈতিক অবস্থান হবে আরো নড়বড়ে ও বিতর্কিত।

প্রধান বিরোধী দলের আপত্তি সত্বেও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে একটি ওয়ার্ডের ১৪টি কেন্দ্র এবং গত ৩০ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচনে ৯টি ওয়ার্ডের ৫৮টি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট হয়। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী জয়লাভ করলে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে প্রধান বিরোধী দলের আপত্তি অনেকটা ঝিমিয়ে পড়ে। প্রশ্ন উঠেছে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার ও সেনা মোতায়েন’র বিষয়ে বিএনপি কতটা শক্ত ও শক্তিশালী অবস্থানে থাকতে পারবে, কারন ইতিমধ্যে দলের আগ্রহী প্রার্থীদের নির্বাচনের বাইরে রাখা স্থানীয় নেতৃত্বের জন্যে খুবই কষ্টকর হয়ে উঠেছে।

গণমাধ্যম সূত্রে প্রকাশ- ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মতে সেনাবাহিনী থাকলেই নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না। গত ৩০ শে অক্টোবরের নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি সম্প্রতি এ মন্তব্য করেন। আশরাফুলের মতে “এ সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত সংসদের উপ-নির্বাচন, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা নির্বাচন ও ইউপি নির্বাচনের কোনোটিতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি” আর এতে এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে সেনাবাহিনী ছাড়া সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব।

কুসিক এর সব কেন্দ্রে (২৭টি সাধারণ ও সংরক্ষিত ৯টি ওয়ার্ডে) ইলেকট্রোনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের প্রস্তুতি সম্পন্ন করছে নির্বাচন কমিশন। ভোটা’র সংখ্যানুপাত- মোট ভোটার ১ লাখ ৬৯ হাজার ২৭৩জন এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ৮৩ হাজার ১৯৯ জন এবং নারী ভোটার ৮৬ হাজার ৭৪জন। মোট ভোটকেন্দ্র হবে ৬৫টি এবং ভোটকক্ষ থাকবে ৪২১টি। এ নির্বাচনকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায় রিটার্নিং কর্মকর্তাকে সহায়তার জন্য ৯ জন সহকারী রিটার্নিং অফিসার যাদের ইতিমধ্যে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

এ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আচরণবিধি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নির্বাচনী ব্যয় সংকোচন সহ অন্যান্য আচরণবিধি লংঘনের উপর নজরদারি ও কাজ করতে শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। দেশের সবচেয়ে ছোট সিটি কর্পোরেশন হিসাবে এ নির্বাচনে র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবিসহ অন্য আইন শৃখলাবাহিনীর পর্যাপ্ত সদস্য নিয়োজিত রাখার প্রশাসনিক প্রস্তুতি চলছে। এছাড়া ও কুসিক নির্বাচনী এলাকায় আচরণবিধি মানা হচ্ছে কিনা তা জানতে শুক্রবার থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত কাজ শুরু করবে মর্মে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ ছহুল হুসাইন। তিনি ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন- ইভিএম নিয়ে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সাথে আবারো আলোচনার দ্বার উন্মোক্ত করেছেন।

সম্ভাব্য প্রার্থীতা নিয়ে এ নির্বাচনে যারা ইতিমধ্যে আলোচনায় এসেছেন তাদের মধ্যে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ দলীয় সমর্থন প্রত্যাশী জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আফজল খান, যিনি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার ‘সবুজ সংকেত’ পাওয়ার দাবি করেছেন । আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার কুমিল্লা সদর আসনের সংসদ যিনি তার সদস্য পদ ছেড়ে নির্বাচন করার আগ্রহ ব্যক্ত করছেন। সরকারদলীয় অন্য পাঁচজন সাংসদ কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তাদেরই পছন্দের প্রার্থী দাঁড় করাতে তৎপরতা চালাচ্ছেন তা যেন ক্রমে ষ্পষ্ট হয়ে উঠছে। “মেয়র পদে আওয়ামী লীগ থেকে সম্ভাব্য চারজন প্রার্থী মাঠে নেমেছেন। তাঁরা পোস্টার-ব্যানার ও জনসংযোগের মাধ্যমে প্রচারও শুরু করেছেন। তাঁদের মধ্যে সম্ভাব্য প্রার্থী আফজল খানের প্রতি সাংসদ আবদুল মতিন খসরুর, আনিসুর রহমানের প্রতি হুইপ মুজিবুল হক, ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক সহসভাপতি (ভিপি) নূর-উর রহমান মাহমুদের প্রতি সাংসদ আ হ ম মুস্তফা কামাল (লোটাস কামাল) ও নাছিমুল আলম চৌধুরীর সমর্থন রয়েছে বলে দলীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে” (প্রথম আলো/নভেম্বর ২৪, ২০১১)

ক্ষমতাসীন দলটির মধ্যে বিদ্যমান অনৈক্য বা বিভাজনের এ সুযোগ কি বিএনপি নেতৃত্ব হাত ছাড়া করবে? জানা যায়, সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জেলার বিএনপি নেতাদের সঙ্গে ইতিমধ্যে বৈঠক করেছেন চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কুমিল্লা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হাজী আমিনুর রশীদ ইয়াসিন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কুমিল্লার সাবেক পৌর মেয়র মনিরুল হক সাক্কু ও সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাক মিয়া। দলীয় ফোরামের বাইরে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসাবে কন্ঠশিল্পী আসিফ আকবরের নামও শোনা যায়।

…”কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সমপাদক মোস্তাক মিয়া বলেন, বিতর্কিত নির্বাচন কমিশনারের ঘোষিত তফসিল তারা মানেন না। ইভিএম পদ্ধতি বাতিল ও সেনা মোতায়েন না করলে বিএনপির এ নির্বাচনে না যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তবে ইয়াছিন গ্রুপ আপাতত গণসংযোগ থেকে বিরত থাকলে দলের অধিকাংশ কর্মী সমর্থকরা কুসিক নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষে…এদিকে মনিরুল হক সাক্কু দল থেকে বহিষ্কারের ঝুঁকি নিয়েও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলেও নগরীতে প্রচারণা রয়েছে। তার সঙ্গে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম, জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি ফজলুল হক ফজলু, শহর বিএনপির সাবেক সভাপতি আবদুর রউফ চৌধুরী, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম কুমিল্লার সাধারণ সমপাদক কাইমুল হক রিংকু, যুবদলের সাবেক সহসভাপতি আবুল হোসেন, জেলা ছাত্রদলের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি সাজ্জাদুল কবীর প্রমুখরা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন…বিএনপি সমর্থক বিপুলসংখ্যক সম্ভাব্য কাউন্সিলর প্রার্থী নিজ নিজ ওয়ার্ডে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা ও গণসংযোগে নেমে পড়েছেন। দল নির্বাচন বর্জন করলেও তারা প্রার্থীতা থেকে সরে দাঁড়াবেন না বলে জানা গেছে (তথ্য সূত্র:সৈয়দ নূরুর রহমান/দৈনিক যায়যায় দিন)

মেয়র প্রার্থীতার দৌড়ে আওয়ামী লীগের আরো যারা রয়েছেন তারা হলেন-আলহাজ্ব ওমর ফারুক, বর্তমানে যিনি কৃষকলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি’র সহ-সভাপতি। ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে ছিলেন সংশ্লিষ্ট। ১৯৬৮-১৯৬৯সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারী কলেজ থেকে ভিপি নির্বাচিত হন। আগ্রহী আছেন বর্তমানে নগর আ’লীগের সাধারন সম্পাদক আবুল কাসেম রৌশন,যিনি অতীতে ছাত্রলীগের রাজনীতি’র সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন।

সম্ভব্য মেয়র প্রার্থী হিসাবে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সহসভাপতি এয়ার আহমেদ সেলিম ও নির্বাচন করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। সম্প্রতি তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন,কুসিক নির্বাচনে মেয়র হলে মহানগরের উন্নয়ন,সন্ত্রাস,দূর্নীতি ও চাঁদাবাজী ও এবং টেন্ডারবাজী দূর করে সুন্দর এক নগর উপহার দেবেন।

কুমিল্লাবাসীকেই বেছে নিতে হবে কে হবেন তাদের সেই মনের মানুষ…নগর ভবনে কে উড়াবেন সেদিন শান্তি’র পায়রা।।

মুক্ত আলোচনা-***লেখকঃ
দেলোয়ার জাহিদ, রিসার্চ ফেলো, সেন্ট পলস কলেজ, ইউনিভার্সিটি অব ম্যানিটোবা ও নোটারী পাবলিক অব সাস্কাচুয়ান, কানাডা। একজন প্রাবন্ধিক, লেখক ও তৃণমূলে মানবাধিকার সংগঠক, এবং সাবেক সভাপতি, কুমিল্লা প্রেসক্লাব ও কুমিল্লা সাংবাদিক ইউনিয়ন ***

Check Also

দাউদকান্দিতে গৃহবধূর রহস্যজনক মৃত্যু

হোসাইন মোহাম্মদ দিদার :কুমিল্লার দাউদকান্দিতে শান্তা বেগম (২৪) নামে এক গৃহবধুর রহস্যজনক মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। ...

Leave a Reply