আরিফুল ইসলাম সুমন ॥
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার দেওড়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা পর্ষদের সভাপতি ও শাহজাদাপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সায়েফ উল্লাহ ঠাকুর ও প্রধান শিক্ষক মুহিত কুমার দেব এর নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রতিবাদ করায় সহকারী শিক্ষক মো. মনিজুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সম্পূর্ণ অন্যায় ও নিয়মবর্হিভূত প্রবীন এই শিক্ষকের বরখাস্তের বিষয়টিকে অভিভাবক মহলসহ এলাকার সচেতন মানুষ মেনে নিতে পারছেন না। দেওড়া গ্রামের একাধিক অভিভাবক জানান, ব্যবস্থাপনা পর্ষদের সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক দু’জনই বিদ্যালয়ের অর্থ আত্মসাৎ সহ নানা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) ছয় লাখ টাকা আত্মসাতের মামলা রয়েছে। তারা দুর্নীতির দায় থেকে রক্ষা পেতে ওই শিক্ষককে বরখাস্ত করেছেন।
এদিকে শিক্ষক বরখাস্তের বিষয়টি নিয়ে উপজেলার শিক্ষক মহলেও চলছে তীব্র আলোচনা-সমালোচনা। শিক্ষক নেতারা বলছেন, শিক্ষক মনিজুর রহমান ষড়যন্ত্রের শিকার। সরাইল বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মাস্টার বলেন, বিদ্যালয়ের সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক নিজেরাই দুর্নীতির সাথে জড়িত। তারা ষড়যন্ত্র করে শিক্ষক মনিজুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করেছেন। আমরা এর নিন্দা জানাচ্ছি। সরাইল উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. সাইদুর রহমান শিক্ষক বরখাস্তের বিষয়ে বলেন, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কোন শিক্ষককে বরখাস্ত করার পূর্বে তিনবার কারন দর্শানোর নোটিশ দিতে হয়। নোটিশের জবাব সন্তোষজনক না হলে এবং অভিযুক্ত বিষয়ের পক্ষে যথোপযুক্ত প্রমাণাদি থাকলেই কেবল বরখাস্ত করা যায়। ওই শিক্ষকের নোটিশ বা প্রমাণাদি সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।
বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত ১৩ নভেম্বর ব্যবস্থাপনা পরিষদের সাধারণ সভায় ওই শিক্ষকের সাময়িক বরখাস্তের বিষয়টি সিদ্ধান্ত হয়। ১৪ নভেম্বর থেকে তা কার্যকর হয়েছে। সহকারী শিক্ষক মনিজুর রহমানের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎসহ ১০টি অভিযোগ আনা হয়েছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক স্বাক্ষরিত সাময়িক বরখাস্তপত্রে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে এর মধ্যে অন্যতম হলো- গত ১০ জানুয়ারী ক্লাশ বর্জনের নেতৃত্বদানকারী ও চলতি বছর সহপাঠ বই পাঠ্যকরণের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিসমিল্লাহ লাইব্রেরি থেকে দেয়া অনুদানের টাকা আত্মসাৎ। ১২ মার্চ, ২৮ মে এবং ২৫ জুন বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও ব্যবস্থাপনা পরিষদের সভায় অনুপস্থিত, বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কতিপয় অভিভাবক সদস্যসহ দলাদলির কারণে বিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের পরিবেশে ব্যাপক বিঘœ সৃষ্টি, ১৮ জুন প্রধান শিক্ষককে শারীরিক নির্যাতন। এ ব্যাপারে মামলাও হয়। ২১ জুন থেকে ২৩ জুন পর্যন্ত ৩ দিন ছুটি মঞ্জুরবিহীন অনুপস্থিত, অনিয়মতান্ত্রিকভাবে বিএড প্রশিক্ষণ গ্রহণ ইত্যাদি। এ চিঠির অনুলিপি কুমিল্লা বোর্ডের চেয়ারম্যান, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক, কৃমিল্লা বোর্ডের সচিব, কুমিল্লা মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা পরিদপ্তরের উপ-পরিচালক, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা), ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শিক্ষা অফিসার, সরাইল উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারকে দেয়া হয়েছে।
বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা পরিষদের অভিভাবক সদস্যা শামীমা চৌধুরী বলেন, শিক্ষক মনিজুর রহমান সভাপতি ও প্রধান শিক্ষকের রোষানলের শিকার। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ১৩ নভেম্বরের সভা সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। সভাপতি ক’জন সদস্য নিয়ে মনগড়াভাবে এ কাজটি করেছেন। আমি এর নিন্দা জানাই। কমিটির শিক্ষক প্রতিনিধি মৌলভী আমিরুল ইসলাম বলেন, মনিজুর রহমানও কমিটির শিক্ষক প্রতিনিধি। তিনি স্পষ্টবাদী ও ন্যায়ের পক্ষে। বিদ্যালয়ের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক তার প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন। তার বরখাস্ত আমাদের দুঃখ দিয়েছে। কমিটির সদস্য দিলীপ কুমার রায় ও হাবিবুর রহমান জানান, ওই সাধারণ সভার বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না। সভাপতির বিরুদ্ধে আমরা ছয় জন সদস্য অনাস্থা দিয়েছি। শিক্ষক বরখাস্তের বিষয়ে আমরা নিন্দা জানাই। বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা শিরিনা আক্তার বলেন, মনিজুর রহমানের মতো একজন শিক্ষক বরখাস্ত হয়েছেন। বিষয়টি ভাবলেই কষ্ট লাগে।
সাময়িক বরখাস্তকৃত শিক্ষক মো. মনিজুর রহমান বলেন, সভাপতি ও প্রধান শিক্ষকের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমি বরাবরই প্রতিবাদ করে আসছি। আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ একটিও সত্য নয়। তারা বিষয়টি সাজিয়েছেন। তাদের সর্বশেষ দুর্নীতি বর্তমান জেএসসি পরীক্ষার্থী তিন ছাত্রীর নামে নবম শ্রেণীর উপবৃত্তির টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করছেন। আমাকে অন্যায়ভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহিত কুমার দেব বলেন, নিয়মের মধ্যে ওই শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। বিদ্যালয়ে উপবৃত্তির টাকা আত্মসাৎ ও দুর্নীতির বিষয়ে প্রধান শিক্ষক জানান, এসব আমার জানা নেই।
বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা পর্ষদের সভাপতি ও আ’লীগ নেতা মো. সায়েফ উল্লাহ ঠাকুর বলেন, অনিয়মের কারণেই শিক্ষক মনিজুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। কমিটির পাঁচজন সদস্য নিয়ে সভা করেই এ সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সঠিক নয়। ওই শিক্ষক লোক হিসেবে ভাল না।