মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এর নামে কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে টিয়ান্‌শী

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, কুমিল্লা থেকে :
টিয়ান্শী (বাংলাদেশ লিঃ) এর বিরুদ্ধে চিকিৎসার নামে প্রতারণা ও মানব দেহের গুরুত্বপূর্ণ স্নায়ু ব্যবস্তা ধ্বংশ সহ লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া উঠেছে। জানা যায়. ১৯৯৫ইং সালে প্রতিষ্ঠিত চীনা টিয়ান্শী কোং লিঃ ২০০৪ইং সালে স্বাস্থ্য সেবার জন্য প্রথম বাংলাদেশে অনুমতি পায় এবং পরের বছর তথা ২০০৫ইং সালে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ থেকে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে ইতিমধ্যে ঢাকাসহ সারা দেশের সকল জেলা ও অধিকাংশ উপজেলায় বিস্তৃতি লাভ করেছে। চায়না টিয়ান্শী কর্তৃক তৈরী বিভিন্ন ইলেকট্রো ম্যাগনেটিভ ডিভাইসের মাধ্যমে তাৎক্ষনিক রোগ নির্ণয় করে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের চিকিৎসায় গ্যারান্টিসহকারে নিরাময়ের কথা বলে থাকে। আর যে সব রোগের চিকিৎসা করার কথা তারা দাবী করে সেগুলো হলÑ “বিনা অপারেশনে হার্টব্লকেজ সরানো, স্তন টিউমার, জরায়ু ক্যান্সার, পাইলস্ (অর্শ), পিত্তথলির পাথর অপসারনসহ আরও অনেক জটিল ও কঠিন রোগের চিকিৎসা। এ ছাড়াও ডায়বেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, প্যারালাইসিস, বাত ব্যাথা, কোষ্ঠ কাঠিন্য, আল্সার, গ্যাষ্ট্রিক, হাঁপানি, সাইনোসাইটিস, যক্ষা, কিডনি সমস্যা, দাঁতের সমস্যা, যৌন সমস্যা, মানসিক সমস্যা, মূত্র থলির প্রদাহ, হাঁড়ের ক্ষয়, মেদ কমানোসহ এইডস্ ও ব্লাড ক্যান্সারের মত ইত্যাদি দুরারোগ্য ব্যাধির সুচিকিৎসা”।

তারা যেসকল ডিভাইস ব্যবহার করে চিকিৎসা করে থাকে সেগুলো হলো- রক্তসঞ্চালন যন্ত্র, আকুলাইফ, আকুপয়েন্ট ট্রেজার, উচ্চ রক্তচাপ প্রশমন যন্ত্র, টিয়ান্শী ড্রিম বায়ো এনার্জি হেলথ্ ম্যাট্রেস প্রভৃতি।

আর যে সকল সম্পূরক খাদ্য পণ্যকে ঔষধ হিসাবে দিয়ে থাকে- সেগুলো হল এন্টিলিপ টি, বিউ-হেলথ্ টি, চিটোসান, ডং চং চাও ক্যাপসুল, স্পিরুলিনা, বেনিফি ক্যাপসুল, লিংঝি স্পোর, ভাইগোরস ক্যাপসুল, প্যানাক্স জিনসেং, নিউট্রিয়েন্ট হাই ক্যালসিয়াম পাউডার, চিলড্রেন নিউট্রিয়েন্ট হাই ক্যালসিয়াম পাউডার, হাই ক্যালশিয়াম লেসিথিন পাউডার, জিঙ্ক প্লাস ইত্যাদিসহ সর্বমোট ২৮টি পণ্য স্বাস্থ্য সেবার নাম দিয়ে বাজার জাত করে থাকে। খোজ নিয়ে জানা যায় এই কোম্পানীটি মূলত কোন হেলথ্ সার্ভিস বা কোন ডায়াগ্স্টিক সেন্টার নয়। এটি একটি মাল্টি লেভেল মার্কেটিং ব্যবসা। আর চিকিৎসা সেবা ও রোগ ডায়াগনসিস একটি ভাউতাবাজী মাত্র। অপর দিকে যে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কথা বলা হয় তা আরেকটি বড় প্রতারণা। এখানে কোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারতো দুরে থাক এমনকি চিকিৎসা সেবার জন্য নূন্যতম জ্ঞানটুকু তাদের.নেই। কুমিল্লায় টিয়ান্শীর নজরুল এভিনিউ অফিসে গিয়ে জানা যায় এখানে যে, বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রয়েছেন তাঁর নাম ডাঃ রাসেল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা জানান যে, কথিত এই ডাঃ রাসেলের বাড়ি কুমিল্লা বুড়িচং উপজেলায়। সে কোন মেডিকেল কলেজ অথবা কোন প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ডাক্তার নয়। সে ঔষধের ফার্মেসীতে চাকুরী করত। এখানে এসে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হয়ে গিয়েছেন। তবে তিনি দাবী করেন চিকিৎসার ব্যাপারে ডাক্তার রাসেলের অনেক অভিজ্ঞতা আছে। এরকম আরও অনেক স্থানে টিয়ান্শী নন মেডিকেল ব্যক্তিদের দিয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের চিকিৎসা দেওয়ার ব্যাপারে বেশ কিছু দিন যাবৎ পত্র পত্রিকায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আরও অনেক খবর বেরিয়েছে। এই টিয়ান্শীতে চিকিৎসা নিতে এসে একজন ভোক্তভোগী জানান, তার নাম মোখলেছুর রহমান(৫৬), পিতা-মৃত সোনা মিয়া, গ্রাম-বুড়িচং এর কংশনগর। সে কুমিল্লা টিয়ান্শীতে ডাক্তার রাসেলের হাত ধরে পিত্তথলী পাথরের চিকিৎসা নিতে এসেছিল। সে বিগত ৬ (ছয়) মাস যাবৎ নিয়মিত চিকিৎসা নিয়েছে, কিন্তু কোন আরোগ্য লাভ করেনি বরং তার কাছ থেকে প্রায় ২২ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বিভিন্ন ভাবে। তিনি এখানকার সকল চিকিৎসা ও চিকিৎসকদের ভূয়া এবং প্রতারক বলে দাবী করেছেন।

কুমিল্লা টিয়ান্শীর পরিচালক মোঃ বোরহান উদ্দিন জানান কোম্পানীর আইন অনুযায়ী তাদের কোন পণ্য সরাসরি বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না। কেউ কিনতে চাইলে এখানে মাল্টি লেভেলিং প্রক্রিয়ায় সদস্য হয়ে তারপর পণ্য কিনতে হয়। সদস্য ফি ১২০০ টাকা। আবার ঐ সদস্য নতুন ২জন সদস্য বানাতে পারলে কোম্পানীর নিয়ম অনুযায়ী নির্দিষ্ট বোনাস পাবে। এভাবে একসাথে পণ্য বিক্রি ও সদস্য সংগ্রহ করে থাকে তারা। এতে করে একদিকে যেমন কোম্পানীর স্বল্প মূল্যের পণ্য বেশী দামে বিক্রি করে তেমনই সদস্যরা লাভের আসায় কোম্পানীর সকল গোপনীয়তা রক্ষা করে চলে। বর্তমানে তাদের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৩ লক্ষাধিক। এখানে রোগী ধরার পদ্ধতিটিও মাল্টি লেভেলিং প্রক্রিয়ায় হয়ে থাকে। প্রতি রোগীর জন্য কনসালটেন্সী ফি বাবত নেওয়া হয় ৫০০/- টাকা। এর মধ্যে ডাক্তার পায় ৩০০/- টাকা এবং দালাল পায় ২০০/- টাকা। কোম্পানীর লাভ হলো এখান থেকে রোগীরা সদস্য হয়ে যে থেরাপী নিবে এবং ঔষধ কিনবে তার লভ্যাংশ। একদিকে কথিত ডাক্তারকে আগে থেকে কোম্পানীর নির্ধারিত ঔষধ ও থেরাপী প্রেসক্রাইব করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া থাকে।

কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের একদল মেধাবী ও বিচক্ষণ ছাত্ররা টিয়ান্শীর এ চিকিৎসা ব্যবস্থাকে মানব দেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর বলে দাবী করেছেন। এ চিকিৎসা পদ্ধতিটি তাদের নিকট আকস্মিকভাবে উৎঘাটিত হয়। তাঁরা জানান কিছুদিন পূর্বে তাদের গবেষণা দলের সদস্য এবং নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ৫ম বর্ষের ছাত্র কুমিল্লা টিয়ান্শীতে রক্ত সঞ্চালন যন্ত্রের মাধ্যমে ওজন কমানোর জন্য থোরাপী নিতে গিয়ে তাদের যন্ত্রের সাহায্যে পরীক্ষা করে জানতে পারেন যে, তাঁর হার্টে বড় ধরণের সমস্যা আছে। তখন তিনি ভয় পেয়ে কলেজে গিয়ে আবারও ইসিজি, এক্স-রে ও অন্যান্য পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হন যে, তাঁর হার্ট সম্পূর্ণ সুস্থ্য আছে। এ ব্যাপারটি ভুল প্রমাণিত হলে তিনি আরও কিছু কৌতুহলী ছাত্র নিয়ে নিজেদের মেডিকেল ছাত্র পরিচয়টি গোপন রেখে আবারও পরীক্ষা করতে যায় কুমিল্লা টিয়ান্শীতে। তাঁদেরকেও পরীক্ষা করে জানানো হয় যে, শরীরে সবারই কোন না কোন মারাত্মক সমস্যা আছে। তবে এখানে সদস্য হয়ে নিয়মিত থেরাপী নিলে সুস্থ হয়ে যাবে। এঘটনার ফলে টিয়ান্শীর প্রতারণার আসল চেহারা ফাঁস হয়ে যায় মেডিকেল ছাত্রদের চোখে। ছাত্ররা বুঝতে পারে এটি একটি প্রতরণার ফাঁদ। তখন তাঁরা টিয়ান্শীর আসল রহস্য উৎঘাটনের জন্য ব্যাপক চিন্তা ভাবনা ও গবেষণা শুরু করে। অবশেষে প্রায় তিন মাস কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে এবং টিয়ান্শীর যন্ত্রপাতি ঘাটাঘাটি করে জানতে পারে মেশিনগুলোর কার্য পদ্ধতি। এ ব্যাপারে কুমিল্লা অফিসের মোঃ বোরহান উদ্দিন এর মাধ্যমে বার বার চেষ্টা করে ও কোম্পানীর উর্ধত্বণ কর্তৃপক্ষের সাক্ষ্যাতকার নেয়া সম্ভব হয়নি

Check Also

দেবিদ্বারে অগ্নিকান্ডে ১কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি

দেবিদ্বার প্রতিনিধিঃ– কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার ফতেহাবাদ ইউনিয়নের জগন্নাথপুর গ্রামে রান্না ঘরের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরনে ১৫টি ...

Leave a Reply