দেশের অন্যতম প্রধান সড়ক ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বেহাল অবস্থা ক্রমেই অবনতিশীল হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় সড়কটির দেখভালো করার কেউ নেই। গত ২০ বছরের মধ্যে এই গুরুত্বপূর্ণ সড়কটির এমন অবস্থা দেখা যায়নি। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত মোট ৩০০ কিলোমিটার সড়কের ১০০ কিলোমিটারই চলার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। পুরো রাস্তার অন্তত ২০-২৫টি স্থানে প্রায় প্রতিদিনই যানজট লেগে থাকে। দু’বছর আগেও ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে সময় লাগত ৫-৬ ঘণ্টা। যেখানে বর্তমানে একই পথ অতিক্রম করতে সময় লাগে ৮-৯ ঘণ্টা। আর কোনো কারণে যদি বড় কোনো যানজটের কবলে পড়তে হয় তাহলে ১৮-২০ ঘণ্টাই কেটে যায় পথে পথে। এমন পিরিস্থিতি হতে পরিত্রাণের জন্য পুরো রাস্তাটি চার লেন করাসহ উন্নয়নের কাজ আগামী ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হবে বলে জানা গেছে।
স্বাধীনতার পর থেকেই এই মহাসড়কের গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে প্রায় সকল সরকারের আমলেই এর উন্নয়নের জন্য একাধিক প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। কিন্তু অপ্রতুল সরকারি বরাদ্দ, ঠিকাদারদের সীমাহীন দুর্নীতি ও নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করায় দ্রুত তা নষ্ট হয়ে যায়। ফলে অল্প সময়ের মধ্যে বড় বড় গর্ত আর খানাখন্দে ভরে যায় রাস্তা। এতে আটকে যানবাহন বিকল হয় যার ফলশ্রুতিতে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজটের। মাঝে মাঝে ৩০-৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজটও চোখে পড়ে।
সরেজমিনে ঘুরে এসে দেখা গেছে, ঢাকার যাত্রাবাড়ি হতে কাঁচপুর সেতু, কুমিল্লার নিমসার, চৌদ্দগ্রাম, মিয়ার বাজার ফেনীর মুহুরী ব্রীজ, চট্টগ্রামের মিরসরাই হতে চট্টগ্রাম শহর পর্যন্ত অন্তত ২৫টি স্থান যানবাহন চলার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তবুও জীবনের তাগিদে চরম অনিশ্চয়তার মাঝেও চলতে হচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষের। উল্লেখযোগ্য বেহাল স্থানগুলো হলো- যাত্রাবাড়ি, শনিরআখড়া, রায়েরবাগ, নিমসার, মিয়ার বাজার, মুহুরীব্রীজ, মিরেরসরাই, বারোইয়ারহাট, বড়তাকিয়া, হাদী ফকিরহাট, নিজামপুর কলেজ, বড়দারোগারহাট, বাঁশবাড়িয়া, বারবকুণ্ড, শীতলপুর, বারআউলিয়া ইত্যাদি। এই অবস্থা হতে পরিত্রাণের উপায় হিসাবে সড়ক ও জনপদ (সওজ)-এর একাধিক কর্মকর্তার কাছ থেকে জানা যায়, আগামি ফেব্রুয়ারি মাস হতে পুরো সড়কটিকে চার লেনে উন্নীত করাসহ সংস্কার কাজ শুরু করা হবে।
ইতিহাস হতে জানা যায়, পূর্বে এই রোডটি গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড নামে পরিচিত ছিলো। মোঘল সম্রাট শেরশাহর সময় এই সড়কটি তৈরি করা হয়। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলামের মতে উত্তর-দক্ষিণে এই একটি মাত্র সড়ককে ঘিরেই পত্তন হয়েছিলো ঢাকা ও চট্টগ্রামের। কিন্তু দুঃখের বিষয়, শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মানুষের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সড়কটির কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয়নি। এখনো সড়কটির অধিকাংশ স্থান এতোটাই সরু, যা কোনো মহাসড়কের জন্য কখনোই উপযোগী নয়। ঢাকা থেকে দাউদকান্দি পর্যন্ত সড়কটি চার লেনের এবং ৪৮ ফুট চওড়া আর বাকি পুরো সড়কটিই দুই লেনের এবং মাত্র ২৪ ফুট চওড়া। দেশের সর্ববৃহৎ সমুদ্রবন্দর এবং বাণিজ্যনগরী চট্টগ্রামের সাথে রাজধানীর একমাত্র সড়ক হওয়ায় এর গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু সরকারের কর্তব্যরত বিভাগসমূহের উদাসিনতা, যানবাহনের মালিক, চালক ও সাধারণ জনসাধারণের অসচেতনতা সড়কটিকে করুণ পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বর্তমান বেহাল দশার কারণে দেশের আমদানি-রফতানি ব্যয় বেড়ে গেছে ৫-৭ ভাগ।
দেশের অন্যতম ব্যস্ত এই সড়কটি দিয়ে প্রতিদিন গড়ে চলাচল করে ২০,০০০ যানবাহন। মেঘনা-গোমতী সেতুর টোল আদায়কারী প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে প্রতিমাসে এই সড়কটির উপর দিয়ে টোল প্রদান করে যানবাহন চলে ৫ লাখ এবং টোল ছাড়া চলে আরও ৫ লাখ যানবাহন। এর মধ্যে ট্রাক ৩৫%, মাইক্রো ও পিকআপ ২৪%, মিনিবাস-মিনিট্রাক ১০-১১%, ট্রেইলর লরি ১.৫-২%।
সেপ্টেম্বর২০০৯ | গাড়ি চলাচলের হিসাব |
|
গাড়ির ধরণ | পরিমাণ |
ক্লাস-১ (মোটর সাইকেল) | ৫০০০টি |
ক্লাস-২ (সিএনজি অটো টেম্পু) | ৯০০০টি |
ক্লাস-৩ (প্রাইভেটকার) | ৭০০০০টি |
ক্লাস-৪ (মাইক্রো-পিকআপ) | ৯৪০০০টি |
ক্লাস-৫ (মিনিবাস-মিনিট্রাক) | ৪৬০০০টি |
ক্লাস-৬ (বাস) | ৬৬০০০টি |
ক্লাস-৭ (ট্রাক) | ১৩৩০০০টি |
ক্লাস-৮ (ট্রেইলর লড়ি) | ৮২০০টি |
ক্লাস-৯ (টোল ফ্রি- পুলিশের ব্যবহার্য যান, সেনবাহিনীর যান ও সওজ-এর ব্যবহার্য যানবাহন) | ১৮২০০টি |
এছাড়া বিভিন্ন জেলা শহর হতে আসা মেঘনা-গোমতী সেতুর ব্যবহার না করে চলে অন্তত ৫ লক্ষ যানবাহন।
দেশের অন্যতম ব্যস্ত ও অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কটির দ্রুত সংস্কার না করলে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হবে আমাদের জাতীয় অর্থনীতি। দেশের সচেতন মহলের মতামত অনুযায়ী সড়কটির সংস্কারে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি পুরো সড়কটিকে ছয় লেনে উন্নীত করতে হবে। না হয় অদূর ভবিষ্যতে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কটি অচল হয়ে পড়বে। তাই যত দ্রুত সম্ভব ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কটিকে একটি আধুনিক মহাসড়কে রূপান্তর করতে হবে।